বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : পুলিশ সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে বেশির ভাগ ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শুনানিতে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসাবে পুলিশ অনুপস্থিত থাকায় মামলার ম্যারিট দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বহু মামলা সরকার পক্ষ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারছে না। এ কারণে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর নেতাকর্মীরা শত শত মামলা মাথায় নিয়ে দিব্বি বহাল-তবিয়তে ঘুরছেন। সংকটের এই বাস্তবতা অনুধাবন করে সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়। যৌক্তিক কারণ ছাড়া সাক্ষী হিসাবে কোনো পুলিশ সদস্য অনুপস্থিত থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বিষয়টিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি। তবে প্রথমত আমরা মনে করি, নির্বাচনের আগে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কেননা পুলিশের কতিপয় ব্যক্তি রাজনৈতিকভাবে শাসক দলের অনুরক্ত। তারাই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রতিপালনের চেষ্টা করছে। তবে এক্ষেত্রে আমরা গোটা পুলিশ বাহিনীকে দোষারোপ করছি না। কারণ এটিসহ যেসব পরিপত্র এর আগেও জারি করা হয়েছে, তা কতটা আইনসম্মত হয়েছে, তা সময়ই বলে দেবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন দায়িত্বশীল সিনিয়র কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির এ অভিযোগ মোটেই ঠিক নয়। মামলায় পুলিশ সাক্ষী যথাসময়ে হাজির করা গুরুত্বপূর্ণ আইনগত বিষয়। সাক্ষী যেই হোক না কেন, তিনি আদালতে হাজির না হলে মামলাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূলত আদালতে মামলাজট কমাতে পুলিশ যথাসময়ে পুলিশ সাক্ষী হাজির করার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি তাদের ‘রুটিন ওয়ার্ক’ এবং পেশাগত দায়িত্ব।
প্রসঙ্গত, ২০ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড এনআরবি অ্যাফেয়ার্স শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি জেসমিন বেগম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, সারা দেশে বিচার চলমান মামলায় পুলিশ সদস্যদের সাক্ষ্যর দিন ধার্য থাকে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশ সাক্ষীরা ধার্য তারিখে অনুপস্থিত থাকেন। এতে বিচার প্রক্রিয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব সৃষ্টি হয়।
এ অবস্থায় যথাসময়ে সাক্ষী হাজির নিশ্চিতকরণ, বিনা কারণে অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেন পুলিশ সাক্ষীর এত অনুপস্থিতি জানতে চাইলে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে বলেন, ‘আমরা পুলিশ সাক্ষীদের অনেকের বিপি বা পরিচিতি নম্বর নথিতে খুঁজে পাচ্ছি না। এ কারণে শুধু নাম ও পদবি দিয়ে সাক্ষী খুঁজে বের করা কঠিন। এটা বদলিযোগ্য চাকরি। ফলে বিপি নম্বর না থাকলে পুলিশ সাক্ষী আদালতে হাজির করা সম্ভব নয়।’ কেন বিপি নম্বর নেই, এর কারণ সম্পর্কে তাদের অনেকে মন্তব্য করতে চাননি।
পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠিতে বলা হয়, ধার্য তারিখে কোনো পুলিশ সদস্য সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির না হলে অনুপস্থিতির বিষয়টি প্রতিবেদন আকারে তার ইউনিটকে প্রতিবেদনসহ জানাতে হবে। অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধানপূর্বক প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আদালতে যথাযথভাবে সাক্ষ্য না দিলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তার ইউনিটকে অবহিত করতে হবে। সাক্ষ্য প্রদানে অনুপস্থিত ও যথাযথ সাক্ষ্য প্রদান করেনি-এমন পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রতিমাসের ৫ তারিখের মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠাতে হবে।
সূত্র জানায়, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মামলা বিচারাধীন। বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা কয়েক লাখ। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতার বিরুদ্ধে দুই থেকে আড়াইশ মামলা ঝুলছে। কেবল মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বিচারাধীন রাজনৈতিক মামলা দেড় হাজারের বেশি। ঢাকার বেশির ভাগ রাজনৈতিক মামলা পল্টন, মতিঝিল ও রমনায়।
আদালত সূত্র জানায়, এ তিন থানায় প্রতিমাসে কয়েকশ সাক্ষী সমন আসে। কিন্তু বাস্তবে সাক্ষী হাজিরে থানা পুলিশের তৎপরতা দেখা যায় না। যেমন জুলাইয়ে পল্টন থানায় ২৭৬টি সাক্ষী সমন পাঠানো হয়। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর জজ আদালত থেকে ৭৪টি এবং সিএমএম কোর্ট থেকে ২০২টি। কিন্তু সমন তামিলের হার অর্ধেকেরও কম। সাক্ষী না আসায় অনেক মামলার তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়। এতে বিচার বিলম্বিত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে পল্টন থানার ওসি সালাউদ্দিন মিয়া বুধবার যুগান্তরকে বলেন, বিচারাধীন অনেক মামলায় সাধারণ সাক্ষীরা অনুপস্থিত থাকলেও পুলিশের সাক্ষী অনুপস্থিতি খুবই কম। তবে বর্তমানে এ বিষয়ে খুবই কড়াকড়ি করা হচ্ছে। তিনি জানান, পুলিশের সাক্ষী অনুপস্থিত হলে উচ্চপর্যায়ে তাদের জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু পুরোনো মামলার যেসব সাক্ষী অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন বা অবসরে গেছেন, তাদের আদালতে পাঠানোর দায়িত্ব তার নয়। এজন্য পুলিশের অন্য একটি বিভাগ কাজ করে।
সূত্র জানায়, ২০ আগস্ট ডিএমপির ক্রাইম কনফারেন্সে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সভায় বলা হয়, অনেক মামলায় সাক্ষী হলেও পুলিশ সদস্যরা আদালতে হাজির হচ্ছেন না। এমনকি কেউ কেউ যথাযথভাবে সাক্ষ্য দেন না। এতে তদন্ত বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে অভিযোগ প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
সভায় উপস্থিত পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাক্ষী অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে কয়েকজন ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দেন। সভায় একজন ওসি বলেন, আদালতে সাক্ষ্য দিতে গেলে যাতায়াত ও খোরাকি ভাতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ খাতে পুলিশের কোনো বরাদ্দ নেই। ফলে অনেকেই সাক্ষ্য দিতে নিরুৎসাহবোধ করেন।
অপর একজন ওসি বলেন, পুরোনো অনেক মামলায় সাক্ষী হিসাবে উল্লিখিত পুলিশ সদস্যের নাম-ঠিকানা যথাযথভাবে লেখা হয় না। এমনকি তার বিপি নম্বরও লেখা থাকে না। এতে সাক্ষী হাজির করতে সমস্যা হয়। বদলি হয়ে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে খুঁজে পাওয়া সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া সাক্ষীদের অনেকে বাসা বদল করায় যথাসময়ে তার কাছে সমন পাঠানো সম্ভব হয় না।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, থানায় সাক্ষী সমন এলে তা রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ রাখা এবং সংশ্লিষ্ট সাক্ষীর কাছে সমন পাঠানোর বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকেন একজন এএসআই (সহকারী উপপরিদর্শক) অথবা কনস্টেবল। কিন্তু ওসি বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের তদারকির অভাবে যথাযথভাবে সমন তামিল করা হয় না। এমনকি অনেক থানার রেজিস্টারে ভুয়া তামিল দেখানো হয়। নির্ধারিত ছকে ‘সমন পাঠানো হয়েছে’ লেখা হলেও বাস্তবে টেবিলেই পড়ে থাকে আদালতের সমন।
তবে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, সাক্ষী হাজিরের দায়িত্ব থানা পুলিশের। বিশেষ করে এ বিষয়ে ইউনিটপ্রধান হিসাবে থানার ওসিরাই দায়বদ্ধ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৭০ থেকে ৭২ ধারায় বিষয়টি স্পষ্ট করা আছে। যদি কোনো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাক্ষী সমন তামিলে ব্যর্থ হন তবে তাকে জারিমানা করার বিধানও আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য এখন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের মোবাইলে ডিজিটাল সমন পাঠানো হচ্ছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট জিআরও (সাধারণ নিবন্ধন) শাখা থেকে দফায় দফায় ফোন করে ধার্য তারিখে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। এরপরও কেউ উপস্থিত না হলে উচ্চপর্যায়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়।
পুলিশ বলছে, একাধিক মামলা বিচারাধীন থাকলেও বিএনপির অনেক নেতাকর্মী স্বাধীনভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারা আদালতে নিয়মিত হাজিরাও দেন না। এমনকি বিএনপির অনেক নেতা আইনি মারপ্যাঁচ কাজে লাগিয়ে বিচার দীর্ঘায়িত করছেন।
কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশ কয়েকজন মামলার বিচার পর্যায়ে রিভিশন দায়ের করেন। কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে মামলাটি চলতে পারে না বলে কোয়াশমেন্টের আবেদন করেন। এর ফলে অনেক সময় নিম্ন আদালতে বিচার কার্যক্রম থেমে যায়।