বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। দেশে জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে সরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জ্বালানি খাতে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বেসরকারি পর্যায়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর মজুদ, পরিশোধন, পরিবহন ও বিপণন খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের বিপণন শুরুর প্রথম তিন বছর উৎপাদিত ৬০ শতাংশ ডিজেল, পেট্রল, অকটেন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল কিনে নেবে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
পাশাপাশি জ্বালানি পণ্য রপ্তানিরও সুযোগ রাখা হয়েছে নীতিমালায়। নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এই খসড়া নীতিমালার একটি কপি কালের কণ্ঠ’র কাছেও রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জ্বালানি খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে চায় সরকার।
এ লক্ষ্যে নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এরই মধ্যে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে খসড়াটি পাঠিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে চলতি মাসে (সেপ্টেম্বর) খসড়া নীতিমালাটি চূড়ান্ত হতে পারে।’ খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, ১৯৭৭ সাল থেকে জ্বালানি তেলের সরবরাহ কার্যক্রমের সঙ্গে বিপিসি সুনামের সঙ্গে যুক্ত আছে।
দেশে জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা, ব্যবহার, স্থানীয় উৎপাদন ও মজুদ সক্ষমতা বিবেচনায় দেশব্যাপী উৎপাদন ও সরবরাহ কার্যক্রমে সরকারি অংশের তুলনায় বেসরকারি পর্যায়ের অংশগ্রহণ সীমিত। সরকারের রূপকল্প-২০৪১, এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে জ্বালানি তেলের সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৭০ থেকে ৭২ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধনের পর জ্বালানি তেল পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলসহ সরকারি বিপণন কম্পানির মাধ্যমে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়।
সক্ষমতা বাড়াতে ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ স্থাপনের প্রকল্প নিচ্ছে বিপিসি, ২০২৭ সালে এর নির্মাণ সম্পন্ন হবে। এর মাধ্যমে আরো ৩০ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করা সম্ভব হবে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে অপরিশোধিত তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রিতে অংশগ্রহণে বসুন্ধরা গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, পেট্রোম্যাক্স, অ্যাকোয়া রিফাইনারিসহ কয়েকটি বেসরকারি কম্পানি প্রস্তাব দিয়েছে মন্ত্রণালয়ে। অনানুষ্ঠানিক আলোচনার ভিত্তিতে এরই মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে রিফাইনারি স্থাপনে ভূমি উন্নয়নসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু করেছে।
এ ব্যাপারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার জ্বালানি তেল আমদানি, পরিশোধন ও বাজারজাতের জন্য বেসরকারি খাতকে যে সুযোগ দিচ্ছে, সেই উদ্যোগটি ভালো। তবে এখানে রিফাইনারি হচ্ছে একটি পার্ট। আরেকটি পার্ট বাজারজাতকরণ। সরকার চাইলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পরিশোধন করা তেল কিনে বাজারজাত করতে পারে। আবার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমেও বাজারে বিক্রি করাতে পারে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম এলপিজির মতো নির্ধারণ করাতে হবে।’
জ্বালানি তেল সরবরাহ ও বিপণন । বেসরকারি শোধনাগারে উৎপাদিত ডিজেল, অকটেন, পেট্রল, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল বিপণন শুরুর প্রথম তিন বছর মোট উৎপাদিত জ্বালানি তেলের ৬০ শতাংশ সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিপিসিকে সরবরাহ করতে হবে। বাকি ৪০ শতাংশ জ্বালানি তেল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ও নিজস্ব নিবন্ধিত বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা বিক্রি করতে পারবে। তবে বিক্রয় নেটওয়ার্কের স্বল্পতার কারণে কোনো বেসরকারি রিফাইনারি ৪০ শতাংশ তেল বিক্রি করতে না পারলে এর যেকোনো পরিমাণ বিপিসির কাছে বিক্রি করতে পারবে। পরবর্তী দুই বছরে বেসরকারি রিফাইনারিগুলো তাদের উৎপাদিত তেলের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিক্রি করতে পারবে।
বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যোগ্যতা । খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, উদ্যোক্তাদের জ্বালানি পণ্য উৎপাদন, বিপণন বা সরবরাহ ও প্ল্যান্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে ন্যূনতম তিন বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথবা এসংক্রান্ত ন্যূনতম পাঁচ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিদেশি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে চুক্তি থাকতে হবে।
বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের গত পাঁচ বছরের মধ্যে যেকোনো তিন বছরে প্রতিবছর টার্নওভার কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বা সমমূল্যের মার্কিন ডলারে হতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে দেশে নিজস্ব কিংবা যৌথ মালিকানায় বার্ষিক ন্যূনতম ১৫ লাখ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন বা প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতাসম্পন্ন রিফাইনারি স্থাপন করতে হবে। তবে বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বা তার কোনো পরিচালক ঋণখেলাপি হতে পারবেন না।
বেসরকারি খাতে শোধনাগার স্থাপনে কমপক্ষে ৮০ একর জমি থাকতে হবে এবং রিফাইনারির অপারেশন (শোধনাগার পরিচালন) কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যূনতম দুই লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন স্টোরেজ সুবিধা থাকতে হবে।
বেসরকারি উদ্যোক্তাকে আবেদনের সময় অফেরতযোগ্য ফি হিসেবে এক কোটি টাকার পে-অর্ডার বিপিসির অনুকূলে প্রদান করতে হবে।
রিফাইনারি স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর আগে নিরাপত্তা গ্যারান্টি হিসেবে বিপিসির অনুকূলে বেসরকারি উদ্যোক্তাকে ২৫০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে।
জ্বালানি তেল পরিবহন ব্যবস্থাপনা। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর প্রয়োজনীয় পরিমাণ লাইটার বা পরিবহনের জন্য নিজস্ব মালিকানায় বা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ন্যূনতম তিন হাজার মেট্রিক টন পরিবহনে সক্ষম তিন-চারটি কোস্টাল ট্যাংকার থাকতে হবে, যার প্রতিটি ডাবল হাল ডাবল বটম হতে হবে। উৎপাদিত জ্বালানি পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহন করার লক্ষ্যে নিজস্ব মালিকানায় বা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টন তেল পরিবহনে সক্ষম চার-পাঁচটি কোস্টাল ট্যাংকার থাকতে হবে। ৮০০ থেকে এক হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার চার-পাঁচটি বে-ক্রসিং শ্যালো ড্রাফট ট্যাংকার থাকতে হবে। এসব জাহাজ আবশ্যিকভাবে ক্লাস শ্রেণিভুক্ত এবং ডাবল হাল ডাবল বটমসমেত হতে হবে।
নদীপথে পরিবহন কম হলে সে ক্ষেত্রে সড়কপথে পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত ট্যাংক লরির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ট্যাংক লরির ধারণক্ষমতা ন্যূনতম ৯ হাজার লিটার থেকে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তার মালিকানাধীন জাহাজ, ট্যাংক লরি ও বিপণন নেটওয়ার্ক নিজস্ব লোগোর মাধ্যমে চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।