ম.ম.রবি ডাকুয়া,বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি : আজ সেই ভয়াল ১৫ নভেম্বর । সিডরে নামক যে ঝড়ের তান্ডব আজও বয়ে বেড়ায় উপকূলবাসী । ২০০৭ সালের এই দিনে ভয়াবহ সামুদ্রিক ঝড় ‘সিডর’ আঘাত হানে বাগেরহাট সহ দেশের উপকূলীয় এলাকায়।রেখে যায় ঝড়ের তান্ডবে স্বজন হারানো ত্রান আসে বাগেরহাটের শরনখোলার সাউথখালি ও এর আশে পাশে।ঘর হলো,বাড়ি হলো অনেক সাহায্য অনেক ত্রান আজো কাঁদে সেই স্বজন হারানো প্রাণ। কান্না।অনেক ত্রান সেই কান্নার ভার আজো লাঘব করতে পারেনি।
শতাব্দির প্রকৃতিক বিপর্য়ের মধ্যে যা ছিল উপকূলে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাত।প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে মুহূর্তের মধ্যেই উপকূলীয় জনপথ আর বাসাস স্থল গুলো মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। রাস্তা-ঘাট, দোকান-পাট,ঘর-বাড়ি, মাঠ-ঘাট এমনকি ঝড়ে উড়ে গিয়ে গাছের সঙ্গে ঝুলে ছিল শত শত মানুষের লাশ। দুর্যোগের সেদিনে গৃহহীন হয় লাখ লাখ মানুষ।রাস্তায় লাশ,পুকুরে লাশ,মানুষ আর গবাদি পশু যেন লাশে লাশে একাকার।
ঘটনার দশটি বছর পেরিয়ে গেলেও সেই স্মৃতির বিস্তৃতি আর স্বজন হারানো কান্না আজও ভুলতে পারেননি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। সহায়সম্বল ও স্বজন হারানো মানুষগুলো ফিরে যেতে পারেননি তাদের স্বাভাবিক জীবনে। এখনও সংস্কার হয়নি বিধ্বস্ত অনেক সড়ক, বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র।
ভয়াবহ এ ঝড় বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানার ৬ দিন আগে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এই ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি। ৯ নভেম্বরে উৎপত্তি হলেও ভয়াবহ রূপটির আভাস পাওয়া যায় ১১ নভেম্বর। পরদিনই এটি ঘূর্ণিঝড় সিডর-এ রূপ নেয়। ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করে স্মরণকালের ভয়াবহ এক মহা দুর্যোগ।সুদির্ঘ্য প্রায় ৬ দিন ব্যপি এ তান্ডব চলে কখনো থেমে থেমে কখনো ভারি কখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তার পর রাত ব্যপি চলে তান্ডব।রেখে যায় কিছু স্বজন হারানো ব্যথা।
সিডর চূড়ান্ত আঘাত হানার আগের দিন অর্থাৎ ১৪ নভেম্বর সারা দেশের আকাশ ছিল মেঘলা। আবহাওয়া অফিস প্রথমে ৫ নম্বর সংকেত দিতে থাকেন। রাতেই তা ৮ নম্বর বিপদ সংকেতে পৌঁছে মোংলা বন্দরে যখন ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষনা করা হয় দেশের সকল সংবাদ কর্মি ভিড় করতে থাকে মোংলা বন্দরে অবস্থান নেয় স্থানীয় হোটেল গুলোতে। ১৫ নভেম্বর সকালে ঘোষণা হয় ‘সিডর’ নামের ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের উপকূলে। দুপুর নাগাদ তা বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করবে। ঘোষিত ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতে আতংকিত হতে থাকে উপকূলবাসী কেউ ছোটে আশ্রয় কেন্দ্রে কেউ অবস্থান নেয় বাড়িতে ।
মুহূর্তে উপকূলের মানুষ যেন আরো মহা বিপদের মুখোমুখি হয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তারা । দমকা হাওয়া বইতে থাকে।সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি । কিছু মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে পারলেও বেশির ভাগ মানুষ থেকে যায় নিজ বাড়িতে। রাত ১০ টার দিকে প্রবল বাতাসের সঙ্গে যুক্ত হল জলোচ্ছ্বাস। সিডর চূড়ান্ত আঘাত হানে । রাত ১০টার পরই মূলত ঘূর্নিঝড় সিডর উপকূলীয় এলাকার বাগেরহাটের মোংলা,রামপাল,মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলার সাউথখালী ও সুন্দরবরেনর অদূরে দুবলারচরে আঘাত হানে। এ সময়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। যা দমকা হাওয়া আকারে আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। তার সঙ্গে ছিল ২০ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস। ঝড়ের ব্যাসার্ধ ছিল ৭৪ কিলোমিটার, যা মুহূর্তের মধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ভোলা, লক্ষ্মীপুরে বিস্তৃত হয়।
নিমেষেই ধ্বংশ স্তুপে পরিনত হয় জনপদ ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা। জলোচ্ছ্বাসে তোড়ে ভেসে গেল হাজার হাজার মানুষ। পরের দিন চারদিকে শুধুই ধ্বংসলীলা। উদ্ধার হল লাশের পর লাশ।মানুষ আর গবাদি পশু। দাফনের জায়গা নেই, রাস্তার পাশে গণকবর করে চাপা দেওয়া হল বহু লাশের। স্বজন সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল উপকূল এলাকার কয়েক লাখ মানুষ।গবাদিপশুর মৃতদেহে এলাকা দূষিত হয়ে পড়ে।
প্রলয়ংকরি এ সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দেশের ৩০টি জেলা। ঝড়ে প্রায় ৫ হাজারের অধিক মানুষ মারা যায়। দক্ষিণের উপকূলীয় জেলাগুলো পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। সরকারি হিসেবে সিডরে ৩৩৪৭ জন মানুষ নিহত, ৫৫২৮২ জন আহত ও ৮৭১ জন নিখোঁজ হয়। গবাদী পশু মারা যায় ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ৫০৭টি। ৩০টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এর মধ্যে ১২ টি জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০টি উপজেলার ১৯৫০টি ইউনিয়নের প্রায় ২১ লাখ পরিবারের ৮৯ লাখ ২৩ হাজার ২৫৯ জন মানুষ, ১৬৯৬১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ২৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমির ফসল, ১৫ লাখ ১৮ হাজার ৯৪২টি বাড়ি, ৮০৭৫ কিলোমিটার সড়ক এবং ৩৫৬২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আজও প্রিয়জন হারা অনেকেই এখনো এই দিন এলে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন । সিডরের ক্ষতচিহ্ন বহন করে চলেছেন অনেকে। প্রিয়জন হারানোর সময় কালের উপমায় এখনো ব্যবহৃত হয় সিডরের নাম।প্রত্যন্ত জনপদে এখনো স্বজন হারা মানুষের বিলাপ শোনা যায়।এখনো অনেকের মানে স্বজন হারানো কান্না আর অর্তনাদ বয়ে চলছে।