বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : ৫ অক্টোবর হস্তান্তর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার সঙ্গে ভার্চুয়ালি যোগ দেবেন ভ্লাদিমির পুতিন । সব প্রস্তুতি শেষ। ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই দেশে আসবে দেশের সবচেয়ে বড় মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউরেনিয়াম জ্বালানি। ৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সশরীরে উপস্থিতি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে হস্তান্তর হবে এটি। কিন্তু এর সঞ্চালন লাইন প্রস্তুতির কাজ চলছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের তত্ত্বাবধানে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এটি নির্মাণ করছে। রিভার ক্রসিংসহ অন্যান্য সঞ্চালন লাইনের এখনো অনেক কাজ বাকি, যা শেষ হতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। জ্বালানি আসা বা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও দুই বছর উৎপাদন না করেই বসিয়ে রাখতে হবে কেন্দ্রটিকে। যার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, এই কাজে নদী শাসনের কোনো অগ্রগতিই হয়নি। রূপপুরের বিদ্যুৎ আনতে সঞ্চালন লাইনের মধ্যে পদ্মা নদীতে ২ কিলোমিটার ৪০০ কেভি রিভার ক্রসিং লাইনের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। কাজ পুরোপুরি শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। একইভাবে যমুনা নদীতে ৭ কিলোমিটার ৪০০ কেভি রিভার ক্রসিং লাইনের কাজও শেষ হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। এটির কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। যমুনা নদীতে ৭ কিলোমিটার ২৩০ কেভির রিভার ক্রসিংয়ের কাজের ভৌত অগ্রগতিও হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ, যা শেষ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে।
সাতটি প্যাকেজে রূপপুরের সঞ্চালন প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে রূপপুর-বাঘাবাড়ি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণ হয়েছে ৬৫.৩ কিলোমিটার। যার ভৌত অগ্রগতি ১শ’ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে ২০২২ সালের ২০ জুন। আমিনবাজার-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণ হয়েছে ৫১ কিলোমিটার। যার ভৌত অগ্রগতি ৯৪ শতাংশ। শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে আরও যেসব লাইনের কাজ শেষ হবে সেগুলো হলো রূপপুর-ঢাকা ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণ (৭৭%), রূপপুর- গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি সিঙ্গেল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণ (৮০%), রূপপুর-ধামরাই ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন (৮৮%), রূপপুর-বগুড়া ৪০০ কেভি সিঙ্গেল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণ (৮৭%), বে এক্সটেনশন (৬১শতাংশ)।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজ নিয়ে শুরু থেকেই দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। কাজে কম গতি থাকায় সময়মতো শেষ করা নিয়ে বিভিন্ন সময় শঙ্কা প্রকাশ করেছে রূপপুর প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। আর প্রকল্প এলাকায় টাওয়ার নির্মাণের জমি বুঝিয়ে না দেওয়ার জন্য রূপপুর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে পিজিসিবি।
কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতা সামনে রেখেই জ্বালানি গ্রহণে প্রস্তুত বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলছে, এই জ্বালানি প্রস্তুত হয়েছে রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় নভোসিবিরস্ক কেমিক্যাল কনসেন্ট্রেটস প্ল্যান্টে (এনসিসিপি)। প্রথম কার্গোতে ১৬৮টি ফুয়েল অ্যাসেমব্লি আসবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম-২৩৮ ও ইউরেনিয়াম-২৩৫-এ দুই আইসোটোপ ব্যবহৃত হয়। খনিতে প্রাপ্ত আকরিকে (ইয়েলো কেক) প্রথমটির পরিমাণ ৯৯ দশমিক ৩ শতাংশ এবং অন্যটির মাত্র দশমিক ৭ শতাংশ। চুল্লিতে ফিউশন বিক্রিয়ায় অংশ নেয় মূলত ইউরেনিয়াম-২৩৫। জ্বালানিতে এর পরিমাণ ৫ শতাংশ পর্যন্ত থাকতে হয়।
এ জন্য কারখানায় নানা প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়। ইউরেনিয়াম ডাইঅক্সাইডকে নানা ধাপে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে ছোট ছোট প্যালেট তৈরি করা হয়। প্যালেটগুলো প্রায় ৪ মিটার লম্বা ফুয়েল রডের মধ্যে রাখা হয়। রূপপুরের জন্য তৈরি একটি রডে ৩১২ থেকে ৩১৩টি প্যালেট থাকে। ৩২০টি রড নিয়ে একটি ফুয়েল অ্যাসেমব্লি হয়। রূপপুরে একটি চুল্লিতে এমন ১৬৩ অ্যাসেমব্লি বসানো হবে। একবার বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর পর একবারে সব অ্যাসেমব্লি পরিবর্তন করা হয় না। নির্দিষ্ট সময় পর পর ৩০ শতাংশ করে ফুয়েল পরিবর্তন করা হয়। এভাবে ধাপে ধাপে সব অ্যাসেমব্লি বদলানো হয়।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলছে, রাশিয়া জ্বালানি পাঠানোর সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। এবার তা গ্রহণ করার পালা। কিভাবে গ্রহণ করা হবে, জানতে চাইলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তা অলক চক্রবর্তী জনকণ্ঠকে বলেন, রূপপুরের প্রথম ব্যাচের ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল আনতে গত ৯ আগস্ট চূড়ান্ত প্রটোকল সই করে ঢাকা ও মস্কো। এর আগে গত মে মাসে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন প্রস্তুতিসংক্রান্ত সনদ সই করে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে পারমাণবিক জ্বালানি আনতে সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আনা হচ্ছে জ্বালানি। নিয়ম অনুযায়ী জ্বালানি পরিবহন করতে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) অবহিত করতে হয়। সে আনুষ্ঠানিকতাও শেষ হয়েছে।
তিনি বলেন, রাশিয়া থেকে কয়েক ধাপে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম আসবে বাংলাদেশে। প্রথম ব্যাচ ইউরেনিয়ামের পর আরও দুই ব্যাচ সাধারণ চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া থেকে বিনামূল্যে পাওয়া যাবে। তিন ব্যাচে প্রথম তিন বছরের জন্য জ্বালানি আসবে। বাংলাদেশে দুই ইউনিটে বছরে লাগবে ৭০-৮০ টন ইউরেনিয়াম রড। তিনি জানান, রাশিয়া থেকে বিশেষ বিমানে ঢাকায় আনা হবে তেজস্ক্রিয় এই জ্বালানি। এর পর কড়া নিরাপত্তা ও গোপনীয়তায় সড়কপথে বিশেষভাবে প্রস্তুত গাড়িতে পাবনার রূপপুরের প্রকল্প স্থানে নেওয়া হবে। দেশে পরিবহনকালে এবং সংরক্ষণের সময় দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণের জন্য বিমা করা হচ্ছে না। এ দায় সরকার নিচ্ছে। এ জন্য আর্থিক নিশ্চয়তাপত্র ইস্যু করেছে অর্থ বিভাগ।
এর আগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর কথা বলা হলেও গত ২৪ জুন এক অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান জানান, আগামী সেপ্টেম্বরেই উদ্বোধন হবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির। উদ্বোধনের সময় ভার্চুয়ালি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও যোগ দেবেন। যা সত্যি হতে যাচ্ছে। কিন্তু শুরু থেকেই শঙ্কায় থাকা কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ সরবরাহের সঞ্চালন লাইন তৈরিতে সমন্বিতভাবে কাজ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উইং বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির নির্মাণ কাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ও তদারকি করছে। এর আগে সঞ্চালন লাইন তৈরি করতে না পারায় প্রায় দেড় বছর বসিয়ে রাখতে হয়েছে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে। জরিমানা গুনতে হয়েছে মাসে মাসে। একই কারণে এবার শঙ্কা দেখা দিয়েছে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নিয়েও। যা নিয়ে বেশ কয়েক দফায় দুই মন্ত্রণালয়ের বৈঠকও হয়েছে।
এসব বিষয় নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, সঞ্চালন লাইনের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে সমন্বিতভাবে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।
এটি তৈরিতে দেরির কথা স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। তিনি বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে রূপপুরের সঞ্চালন লাইনের কাজ পিছিয়ে গেছে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে না হলেও কাজ শেষ করতে খুব একটা দেরি হবে না। সঞ্চালন লাইনের উপকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দুই পক্ষের কারণেই একটু দেরি হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধনের প্রস্তুতিকে লৌকিকতা বলে অভিহিত করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, এর আগে আমরা দেখেছি পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন হলেও সঞ্চালন লাইন না থাকায় দীর্ঘদিন এর থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়নি। রামপালেরও একই অবস্থা ছিল। এবার বলা হচ্ছে রূপপুরের বিদ্যুৎ অনেক কম মূল্যে গ্রাহকরা পাবে। যেহেতু এটির জ্বালানি একবার আনলেই হবে। তাই বাড়তি খরচ নেই। কিন্তু শুধু সমন্বয়ের অভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন হলেও এটির উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে। কারণ বিদ্যুৎ তো জমিয়ে রাখা যাবে না। সঞ্চালন লাইন না থাকলে এই বিদ্যুৎ কোনো কাজেই আসবে না। দুই বছর বিনা উৎপাদনে বসিয়ে রাখতে হবে এটিকে। যা অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।