বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : উন্নত যাত্রীসেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের যাত্রা শুরু হলো। গতকাল শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃষ্টিনন্দন এই টার্মিনালের একাংশ উদ্বোধন করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনাল ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি বিশেষ ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে যায়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের কেন্দ্র (এভিয়েশন হাব) হবে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সেভাবেই গড়ে তোলা হচ্ছে। উড়োজাহাজের জ্বালানি জেট ফুয়েল যাতে পাইপলাইনে আসে, সেই কাজও আমরা শুরু করে দিয়েছি। খুব শিগিগির সেটা বাস্তবায়িত হবে।’
‘স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার সংযোগ’ স্লোগানে তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, জাপানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপমন্ত্রী মাসাহিরো কোমুরা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব মোকাম্মেল হোসেন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
বর্তমানে দেশে-বিদেশে যোগাযোগের জন্য আকাশপথের ভূমিকা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন আকাশযাত্রা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, তখন আমাদের বিমানবন্দরে কিছুই ছিল না। তখন থেকেই উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম ও সিলেটে দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করি।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রাচীন যুগ থেকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে যদি উন্নত করতে পারি, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাব হতে পারে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা দেখেছি পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় কিছু পরিবর্তন হয়; যেমন—একসময় হংকং ছিল আন্তর্জাতিক হাব, এরপর হলো সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, এখন দুবাই। আমি বিশ্বাস করি, পূর্ব ও পশ্চিমের আকাশপথের মধ্যবর্তী হওয়ায় একসময় আমাদের কক্সবাজার বা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর হবে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন হাব।’
আন্ত জেলা যোগাযোগে বিমানে যাতে যাতায়াত করা যায়, সেই উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘রিফুয়েলিংয়ের জন্য এখানে সবাই আসবে। এলে বাংলাদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করবে আর কক্সবাজারে নামলে তো আমাদের দীর্ঘ বালুকাময় সি বিচের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। সেভাবেই আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই। প্রযুক্তিসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলে মানুষের যোগাযোগ সহজ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন—সব কিছু উন্নত করার ব্যবস্থাই আমাদের সরকার করবে।’
তিনি বলেন, ‘ঝরঝরে বিমানের যুগ পেরিয়ে এখন বিমানের বহরে ২১টি অত্যাধুনিক বিমান যোগ হয়েছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করছে। এ ছাড়া এই তৃতীয় টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে আমাদের আড়াই হাজার নতুন পথ সৃষ্টি হবে।’
দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে সরকার বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে লালমনিরহাটে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখি আমাদের আশপাশের দেশ চাঁদে চলে যায়। তাই আমরা কেন পিছিয়ে থাকব, আমরাও চাঁদে যাব। ভবিষ্যতে সেভাবেই আমরা স্মার্ট জনশক্তি গড়ে তুলব।’
আওয়ামী লীগ সরকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর আগে এভিয়েশন খাত উন্নয়নে কোনো সরকার এত উদ্যোগ নেয়নি। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছে, তাদের জন্য কিছু করেছে। মানুষকে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছে। বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশকে চেনে সবাই।
বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভরশীল হতে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর ওপর আবারও জোর দেন।
সফট ওপেনিংয়ে যাত্রীর মতো করে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী
নতুন টার্মিনালে অটোমেশন সিস্টেমে কিভাবে বোর্ডিং পাস হবে, তা করে প্রধানমন্ত্রীকে দেখানো হয়। বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান নতুন এই টার্মিনালের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘুরিয়ে দেখান। বিমান প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী ও সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে একটি ডামি বোর্ডিং পাসও দেওয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী ইমিগ্রেশন কাউন্টারও পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে তিনি প্রি-বোর্ডিং সিকিউরিটি স্ক্যানিং জোনে যান। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বোর্ডিং ব্রিজে। এ সময় তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের বিভিন্ন স্থিরচিত্র দিয়ে সাজানো একটি ফটো গ্যালারি পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী।
তৃতীয় টার্মিনাল থেকে উড়ল বিমানের ফ্লাইট
সফট ওপেনিংয়ের পর রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদেশের নেপালগামী একটি ফ্লাইট তৃতীয় টার্মিনাল ব্যবহার করে ঢাকা ত্যাগ করবে। সেই ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংও করেন বিমানের কর্মীরা।
এই টার্মিনালের একাংশে এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে দুটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষামূলক অংশ হিসেবে টার্মিনাল-৩-এর পার্কিং বেতে থেকে প্রথমবারের মতো ফ্লাইটে যাত্রী তুলেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট।
যেসব সুবিধা তৃতীয় টার্মিনালে
তৃতীয় টার্মিনাল তিনতলাবিশিষ্ট। এর আয়তন দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। যাত্রী ধারণ সক্ষমতা হবে বছরে এক কোটি ৬০ লাখ। কার পার্কিংয়ে এক হাজার ২৩০টি গাড়ি রাখা যাবে। একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্কিং বেতে রাখা যাবে। টার্মিনাল ভবনের প্রথম তলায় রয়েছে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম, ভিভিআইপি, ভিআইপি ইত্যাদি, দ্বিতীয় তলায় বহির্গমন লাউঞ্জ, ক্যান্টিন, বোর্ডিং ব্রিজ এবং তৃতীয় তলায় বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, বিদেশগামী যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, চেক ইন কাউন্টার, সিকিউরিটি সিস্টেম ইত্যাদি।
চেক ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি, এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি। ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকছে ১২৮টি। এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ইমিগ্রেশন কাউন্টার ১৫টি। বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৬৬টি। আগমনী ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৫৯টি। ভিভিআইপি তিনটি। বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে প্রথম পর্যায়ে ১২টি। পরে আরো ১৪টি যুক্ত করা হবে। বর্তমান টার্মিনাল দুটির সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের কোনো সংযোগ থাকবে না। তবে পরবর্তী সময়ে প্রকল্পে করিডর নির্মাণ করা হবে। এই টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হতে আরো এক বছর সময় লাগবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।