বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে সরকারের সাফল্য ব্যাপক। করোনার মধ্যেও বিশ্বের যে তিনটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৫৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কার্যকর ভূমিকা রাখা, উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখতে মৎস্য খাত ভূমিকা অব্যাহত রেখে চলেছে।
গ্রামীণ অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সমৃদ্ধি সর্বোপরি দারিদ্র্য দূরীকরণে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য। করোনা সংকটের মধ্যেও দেশে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম উৎপাদন সরবরাহ ও বিপণন স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার ২০২২’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে (ছয় বছর ধরে পঞ্চম অবস্থানে ছিল), যা ২০২২ সালে মৎস্য খাতের অনন্য এক অর্জন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধনে কাজ করছে সরকারমাছ উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধনে কাজ করছে সরকার
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, করোনার মধ্যেও বিশ্বের যে তিনটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ এক কোটি ৯৫ লাখ বা ১২ শতাংশের বেশি মানুষ মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মাছ ও চিংড়িসহ অন্যান্য জলজ সম্পদের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের পুষ্টিচাহিদা পূরণ এবং রফতানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে উন্মুক্ত জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সুফলের মাধ্যমে দরিদ্র্য মৎস্যজীবী ও চাষি তথা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের চারটি উৎস রয়েছে। এগুলো হলো—অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়, আধালোনা পানির জলাশয় ও সামুদ্রিক জলাশয়।
দারিদ্র্য দূরীকরণে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্যদারিদ্র্য দূরীকরণে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য
অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়
মুক্ত এলাকার সঙ্গে যুক্ত জলাশয়কে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় বলে। এর মধ্যে রয়েছে নদী ও খাড়ি অঞ্চল, হাওর, বিল, হ্রদ ও প্লাবনভূমি। প্লাবনভূমি বর্ষাকালে পানিতে ভরে নদীর সঙ্গে একাকার হয়ে যায় এবং শুকনো মৌসুমে জমিতে পরিণত হয় এবং তখন সেখানে ফসলের চাষাবাদ করা হয়। বর্তমানে দেশে মোট মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ ৪০ লাখ ৪৭ হাজার ৩১৬ হেক্টর।
অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়
অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ের যেসব জলাশয় নদী, হাওর বা বিলের সঙ্গে যুক্ত নয়, এদের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় বলে। অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে পুকুর, দিঘি, বাঁওড় ইত্যাদি। বর্তমানে দেশে মোট বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ১ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৮ হেক্টর।
আধালোনা পানির জলাশয়
আধালোনা পানির জলাশয় নদী ও সমুদ্রের সঙ্গমস্থলকে আধালোনা পানির জলাশয় বলে। এসব এলাকা নদীর পানিবাহিত পুষ্টিকারক ও সমুদ্রের পানির পুষ্টিকারক দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। আধালোনা পানির জলাশয় যেকোনও জলাশয়ের তুলনায় অধিক উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। দেশে আধালোনা পানির অঞ্চল সাতক্ষীরা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। উপকূলীয় চিংড়ি খামার এলাকা বা আধালোনা পানির জলাশয়ের আয়তন ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর।
সামুদ্রিক জলাশয়
সামুদ্রিক জলাশয় সামুদ্রিক জলাশয়ের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা ২০০ নটিক্যাল মাইল এবং মহিসোপান ৮৫ হাজার ১৫৩ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। দেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এটি সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের উৎস। সামুদ্রিক জলাশয়ে আর্টিশনাল ফিশারি ও ট্রলি ফিশারি দিয়ে মাছ ধরা হয়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের প্রায় ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ আছে। এ ছাড়া এসব জলাশয়ে আরও ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি মাছ আছে। মাছের প্রজাতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ আছে। এ ছাড়া এসব জলাশয়ে আরও ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি মাছ আছে। সামুদ্রিক এলাকায় রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ এবং ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি মাছ। মাছের শ্রেণিবিন্যাস বিভিন্ন রকম হতে পারে।
চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানেচাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৭ লাখ ৫৯ হাজার মেট্রিক টন, যা ২০১০-১১ অর্থবছরের মোট উৎপাদনের (৩০ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টন) চেয়ে ৫৫ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। ৩৮ বছরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ছয় গুণের অধিক। মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। দেশের মোট জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ, কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান।
বর্তমানে দেশের রফতানি আয়ের ১ দশমিক ২৪ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। বিশ্বের ৫০টির অধিক দেশে মাছ রফতানি হয়। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ৪২ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৫ হাজার ১৯১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে গৃহীত নানা উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। এই সময়ে মাছে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা, মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থাপনা, মৎস্য খাতে গবেষণার উন্নয়ন, বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছের চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, নতুন জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দেশের মৎস্য খাতে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।
ইলিশ আহরণে বাংলাদেশ প্রথম অবস্থানে রয়েছেইলিশ আহরণে বাংলাদেশ প্রথম অবস্থানে রয়েছে
তিনি বলেন, ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৮ দশমিক ১৪ লাখ মেট্রিক টন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে পাঁচ গুণের অধিক। ২০২০-২১ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে ৪৬ দশমিক ২১ লাখ মেট্রিক টন, যা ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট উৎপাদনের চেয়ে ৫০ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি। দেশের মৎস্য খাতের এ অর্জনে স্বীকৃতি মিলেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার ২০২২’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশের আগে রয়েছে কেবল ভারত ও চীন। ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পঞ্চম অবস্থানে ছিল। এ অর্জন অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের। এ ছাড়া এফএওর প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টাশিয়ান্স ও ফিনফিশ উৎপাদনে যথাক্রমে ৮ম ও ১১তম স্থান অধিকার করেছে। এ ছাড়া বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম, তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ার তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
চাষের মাছ উৎপাদনে তৃতীয় বাংলাদেশ। স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে। ইলিশ আহরণে প্রথম (বর্তমানে ইলিশের মোট উৎপাদন ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টন) অবস্থানে রয়েছে। সুনীল অর্থনীতির বিকাশে সমুদ্রে প্রচলিত ও অপ্রচলিত মৎস্যসম্পদ অনুসন্ধান, সংরক্ষণ ও টেকসই আহরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন কর্মকৌশল প্রণয়ন এবং তা এসডিজির সঙ্গে সমন্বয় করে হালনাগাদ করা হয়েছে। এরই মধ্যে সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০ ও সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২২ প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের সমুদ্রসীমায় মনিটরিং, কন্ট্রোল ও সার্ভিল্যান্স জোরদারকরণে ১০ হাজার আর্টিসানাল মৎস্য নৌযান ও ৫টি বাণিজ্যিক মৎস্য নৌযান প্রযুক্তিভিত্তিক ভেসেল মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় আনা হয়েছে।
চাষিদের উৎপাদিত বাগদা চিংড়িচাষিদের উৎপাদিত বাগদা চিংড়ি
মাছ সংরক্ষণের অংশ হিসেবে ৩৭ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজননকৌশল ও চাষপদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেশীয় মাছের লাইভ জিন ব্যাংক। জিন ব্যাংকে এখন পর্যন্ত ১০২ প্রজাতির মাছ সংরক্ষিত আছে।
মৎস্য অধিদফতর থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮৬ জন মৎস্যজীবী-জেলের নিবন্ধন এবং ১৪ লাখ ২০ হাজার জেলেকে পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয়েছে। ১৬ লাখ ২০ হাজার মৎস্যজীবী-জেলের নিবন্ধন ও ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হয়েছে। রাজস্ব খাতের আওতায় জেলেদের নিবন্ধন কার্যক্রমও চলমান।
২০১০ সালের সর্বশেষ খানা জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশে বছরে প্রতিজন প্রায় ১২ কেজি মাছ খেতো। এখন সেটা ৩০ কেজিতে পৌঁছেছে। দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। জিডিপিতে কৃষির অবদান কমলেও মৎস্য উপখাতের অবদান কিছুটা বেড়েছে। গত অর্থবছরে মৎস্য উপখাতের অবদান বেড়ে ৩ দশমিক ৫২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে টাকার অঙ্কে মৎস্য উপখাত থেকে জিডিপিতে যুক্ত হয়েছে ৮২ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৭৪ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১০ শতাংশ।