বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তি ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য যুদ্ধ বন্ধ এবং দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা পুনরুদ্ধার করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মানুষে মানুষে যোগাযোগ শান্তি ও অগ্রগতির লাইফলাইন। আমাদের অবশ্যই যুদ্ধ, সংঘাত এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসান ঘটাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ব্রাসেলসে তার আবাসস্থলের জিজিএফ কনফারেন্স হলে বুধবার ‘গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম’ সম্মেলনের উদ্বোধনী পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের পরও জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সহায়তার জন্য বেলজিয়ামে বাংলাদেশ, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি) ও ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) মধ্যে তিনটি ঋণ ও অনুদান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
ইইউকে বাংলাদেশের জন্য একটি বিশ্বস্ত বাণিজ্য, উন্নয়ন ও মানবিক অংশীদার হিসাবে বর্ণনা করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী ইইউভুক্ত দেশগুলোকে বাংলাদেশে বিশেষ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং দেশজুড়ে হাইটেক পার্ক নির্মাণে বৃহত্তর বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগের অন্যতম আকর্ষণীয় পরিবেশ প্রদান করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাই আমি ইইউ বিনিয়োগকারীদের আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কের সুবিধাগুলো অন্বেষণের আমন্ত্রণ জানাই।
প্রধানমন্ত্রী চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় ইসরাইলি হামলার প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় আরও ভালো প্রস্তুতি ও পারস্পরিক সম্মান পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায় আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের অবশ্যই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে বোঝাপড়ার প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম ২০২৩-এর সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য এটি এক মহান সংযোগ হিসাবে কাজ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, সবুজ হাইড্রোজেন উন্নয়নে বাংলাদেশ ইইউর সঙ্গে যোগ দিতে ইচ্ছুক। আমরা সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দক্ষতা থেকে উপকৃত হতে পারি। আমাদের কৃষি উৎপাদন সংরক্ষণের জন্য কোল্ড চেইন নেটওয়ার্কগুলোতে বিনিয়োগের প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস ও চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্প উৎপাদন বহুমুখীকরণে ইইউর প্রচেষ্টাকে সহায়তা করতে পারে। আমরা আমাদের আগামী দিনের ইনস্টিটিউটগুলোর জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে অংশীদার খুঁজছি। বাংলাদেশের গতিশীল তরুণ জনগোষ্ঠী ইইউর দক্ষতা ও প্রতিভা অংশীদারত্ব কর্মসূচিতে যোগ দিতে প্রস্তুত। আমরা বিশ্বাস করি, গ্লোবাল গেটওয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’র জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অভিন্ন মূল্যবোধ ও অঙ্গীকার ইইউর সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তিনি বলেন, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তিতে আলোচনা শুরু করেছেন। বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্কের এই ৫০তম বার্ষিকীতে আমি আমাদের কৌশলগত সম্পৃক্ততা আরও জোরদার করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি কারণ আমাদের ৭০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ১৫ বছরেরও কম সময়ে ৪৬৫ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। আমরা লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছি। চরম দারিদ্র্য ২০০৬ সালের ২৫.১% থেকে ৫.৬%-এ নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের এলডিসি মর্যাদা থেকে উন্নীত হতে চলেছে।
তিনি বলেন, তার সরকার খাদ্য নিরাপত্তা, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি, কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, বিনা খরচে আবাসন, গ্রামীণ যোগাযোগ, দুর্যোগ স্থিতিস্থাপকতা, জলবায়ু অভিযোজন, ১০০% বিদ্যুৎ কভারেজ, দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ, শিল্প প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা জলবায়ু ঝুঁকি সহনশীলতা ও সমৃদ্ধির দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে কৌশলগতভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত এবং এটির এ অঞ্চলের ৩ বিলিয়ন গ্রাহকের একটি বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও বন্দর অবকাঠামো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডরের অংশ হিসাবে নির্মিত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করেছি। আমরা নেপাল, ভুটান ও উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থল-সংযুক্ত অঞ্চলগুলোকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের বিমানবন্দরগুলো পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করতে পারে। আমরা পরিবহণ নেটওয়ার্ক, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, সবুজ জ্বালানি, ডিজিটাল রূপান্তর, গবেষণা ও উদ্ভাবনের ওপর গ্লোবাল গেটওয়ের ফোকাসের প্রশংসা করি।
শেখ হাসিনা বলেন, অস্ত্র ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি স্কিমই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছে। তিনি বলেন, আমরা শ্রমিকদের অধিকারের পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা ও নিয়মিত অভিপ্রয়াণ সুরক্ষায় আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছি। আমরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন-এই অভিন্ন মূল্যবোধের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছি।
তিনটি ঋণ ও অনুদান চুক্তি স্বাক্ষর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ইসি প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পর বেলজিয়ামে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি) ও ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) মধ্যে তিনটি ঋণ ও অনুদান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন তার বিবৃতিতে বলেন, দুটি বিনিয়োগ প্যাকেজ স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রথমটি হলো-বাংলাদেশে সবুজ রূপান্তর ত্বরান্বিত করার জন্য ৪০০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি অর্থের একটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্যাকেজ। দ্বিতীয় বিনিয়োগ প্যাকেজটি হলো-আমাদের ২০২৩ সালের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা-যা আপনাদের জনপ্রশাসনে এবং কর্মসংস্থান, দক্ষতা এবং শিক্ষা ও সবুজ রূপান্তরে ৭০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিয়োগ রোডম্যাপ। এরপর তিনি বলেন, ‘সুতরাং এটির মাধ্যমে আমাদের অংশীদারত্বের এই নতুন অধ্যায়টি সত্যিকার অর্থেই ভালোভাবে শুরু হচ্ছে।’
বাংলাদেশে জলবায়ুকেন্দ্রিক বিনিয়োগে সহায়তা করার জন্য ‘বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি সুবিধা’ কর্মপরিচালনার জন্য ৩৫০ মিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত ইইউ-গ্যারান্টিযুক্ত কাঠামো ঋণের জন্য বাংলাদেশ এবং ইইউর মধ্যে প্রথম চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ৪৫ মিলিয়ন ইউরো অনুদানের দ্বিতীয় চুক্তিটি ইআইবি ও ইইউর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। জার্মানির সহ-অর্থায়নে ১২ মিলিয়ন ইউরোর ‘পার্টনারশিপ ফর গ্রিন এনার্জি ট্রানজিশন’ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় কমিশনের মধ্যে তৃতীয় চুক্তিটি হয়। যার লক্ষ্য সবাইকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সবুজ জ্বালানি রূপান্তরে একটি নীতি, আইনি কাঠামো ও জলবায়ু বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান, ইআইবি (জিএলও)-এর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মার্কাস বার্ন্ডট ও ইসির আন্তর্জাতিক অংশীদারত্বের মহাপরিচালক কোয়েন ডয়েনস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুক্ত থাকতে ইইউর প্রতি আহ্বান : প্রধানমন্ত্রী ইইউর সদর দপ্তরে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এক বিবৃতিতে বলেন, আমি আশা করি বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আমাদের উন্নয়নে সহায়তার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে জিএসপি+ সুবিধা দেবে। তিনি বাংলাদেশে সাময়িকভাবে আশ্রিত ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য ইইউকে ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্মভূমি মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনই এই সংকটের একমাত্র সমাধান। আমি দ্রুত এই সংকটের একটি টেকসই সমাধানের সঙ্গে যুক্ত থাকতে ইইউর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।