বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের সর্বোচ্চ ব্যয়ের একটি প্রকল্প। পাবনার ঈশ্বরদীতে অবস্থিত এই বৃহৎ প্রকল্পটি দেশের নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি উৎসের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সরকারের মেগা এই প্রকল্পের ছোঁয়া শুধু জ্বালানি উৎসের কাজেই লাগেনি, বদলে দিয়েছে একটি গ্রামের চিত্র।
মহাসড়ক ধরে পাবনা থেকে কুষ্টিয়ার দিকে যেতে ডানে দিয়াড় সাহাপুর। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক বহুতল ভবন। প্রকল্পের আবাসিক এলাকা ‘গ্রিন সিটি’ নির্মাণ করা হয়েছে দিয়াড় সাহাপুর গ্রামে। যেখানে বসবাস করেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত দেশি-বিদেশি ব্যক্তিরা। সাত বছর আগেও দিয়াড় সাহাপুর গ্রামে কোনো উঁচু ভবন ছিল না। দুই পাশে তাকালে চোখে পড়ে বদলের চিত্র। বাঁ দিকে লিচুবাগান আর গ্রামীণ কাঁচা-পাকা বাড়ি। ডানে বড় বড় ইমারত। মহাসড়ক থেকে ঢালু রাস্তা ধরে নামলেই দিয়াড় সাহাপুর গ্রাম। ছোট রাস্তার পাশেই ‘নতুন হাট’ নামে ছোট একটি বাজার। শাকসবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস নিয়ে বাজারে বসেছেন ক্রেতারা। শত শত রাশিয়ান ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাজারে। মনে হয়, রাশিয়ার কোনো শহরে বাঙালিরা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। বাজারটির চারপাশে সেলুন, রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ, ক্যাফে, ক্লাবসহ আধুনিক সব দোকান। রাশিয়ান ভাষায় নাম দেয়া হয়েছে এসব দোকানের। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল প্রকল্পটি হচ্ছে পদ্মা নদীর তীরঘেঁষা পাকশীর রূপপুর গ্রামে। ব্রিটিশ আমলে পুরো রূপপুর জঙ্গলময় থাকার কারণে দিনের আলোয় মানুষ চলতে ভয় পেত। ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালুর মধ্য দিয়ে বদলের শুরু হয় পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর গ্রামের। প্রথম ব্রিটিশরাই এলাকাটি পরিষ্কার করেছিল। এরপর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দিনে দিনে রূপপুর গ্রামকে শহরে পরিণত করেছে। নিভৃত পল্লীতে বাড়তে থাকে মানুষের আনাগোনা। রূপপুর এখন আর গ্রাম নেই। বদলে গেছে গ্রামের দৃশ্যপট। শতবর্ষ পরে এসে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সেখানে তৈরি হয়েছে বড় বড় ভবন। দেশি-বিদেশি নাগরিকদের পদচারণে নিভৃত গ্রামটি রূপ নিয়েছে ছোট্ট এক শহরে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশদের গড়া গ্রামটি এখন রুশদের (রাশিয়ান) পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন ইমারত, হাসপাতাল, রিসোর্ট, বিনোদনকেন্দ্র, বিপণিবিতানসহ নানা স্থাপনা। যে বদলের ছোঁয়া লাগছে জেলাব্যাপী। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বহু মানুষের। বর্তমানে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার রাশিয়ান নাগরিকের পদচারণায় মুখর থাকছে পুরো এলাকা। রাশিয়ানদের চাহিদা বিবেচনায় আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে হচ্ছে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ। এসব প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া হয়েছে রাশিয়ার বিভিন্ন নামের সঙ্গে মিল রেখে। বদলের এই হাতছানি পড়েছে পুরো জেলায়। রাশিয়ানদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে ঈশ্বরদীতে নতুন করে ৩টি রিসোর্ট, ৮টি রেস্তোরাঁ, ১৫টি বেসরকারি হাসপাতাল, ৫টি সুপারমল তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে রূপপুর প্রকল্পে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে জেলার প্রায় ১৫ হাজার মানুষের। ফলে ব্যক্তি উন্নয়নের পাশাপাশি জেলাব্যাপী সার্বিক উন্নয়ন শুরু হয়েছে।
স্থানীয় সবজি বিক্রেতা মো. আলম বলেন, তিন বছর আগেও এখানে তেমন কোনো দোকান ছিল না। এখন অনেক দোকান হয়েছে। তিন বছর ধরে আমি এখানে সবজি বিক্রি করি। প্রতিদিন বিদেশিদের সঙ্গে দেশি ক্রেতারাও সবজি কিনতে আসে। ফল বিক্রেতা রাজন হোসেন বলেন, আগে ঢাকাতে ছিলাম। এখানে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ার পর এখন এই বাজারে ফল বিক্রি করছি তিন বছর ধরে। কাপড় ব্যবসায়ী জিহাদ হোসেন বলেন, গ্রিন সিটি হওয়ার পর থেকে এখানে অনেক রাশিয়ানরা পোশাক কিনতে আসে। প্রতিদিনই তাদের পছন্দমতো জিনিস ক্রয় করে। তাদের চাহিদা মেটাতে অনেক দোকান হয়েছে।
নিউ ড্রাগ ফেয়ায়েরর স্বত্বাধিকারী সাহাবুল হোসেন বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণেই এই এলাকাটি এখন সুপরিচিত। প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষের আনা-গোনা হয়। সপ্তাহে ছুটির দিনগুলোতে বেশি ভিড় হয়। মো. নান্নু বলেন, যদিও আমরা গৃহহারা হয়েছি তবুও আমরা খুশি কারণ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের পুনর্বাসিত করেছেন।
পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. রিয়াজুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ব্রিটিশরা রেললাইন তৈরির পর ঈশ্বরদীতে আর তেমন কোনো উন্নয়ন ছিল না। রূপপুর প্রকল্পের ফলে এলাকার মান উন্নত হয়েছে। বেকার সমস্যা নিরসন হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা উন্নয়নকর্মী এস এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রূপপুর প্রকল্প আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছে। বহু যুবক বেকারত্ব থেকে জীবিকার সন্ধান পেয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি, শ্রমিক নেতা মো. রশিদুল্লাহ বলেন, ব্রিটিশ আমলে পুরো এলাকা ছিল জঙ্গলময়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তৈরির মধ্য দিয়ে রূপপুর গ্রামটির পরিবর্তন শুরু করেছিল ব্রিটিশরা। দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরের যোগাযোগ সৃষ্টি করতে তৈরি করেছিল রেললাইনসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইফুজ্জামান বলেন, রূপপুর প্রকল্প আশপাশের কয়েকটি গ্রাম বদলে দিয়েছে। শত শত মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে এসব অর্জন পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। সবাই খুব আনন্দিত। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর বলেন, নির্মাণকাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য আমাদের যে সক্ষমতা অর্জন করা প্রয়োজন, জ্বালানি সংরক্ষণ ও ভৌত সুরক্ষার জন্য যে নিরাপত্তা প্রয়োজন, এর সব সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি। পারমাণবিক কেন্দ্র পরিচালনার জন্য আমরা দক্ষ জনবল তৈরি করেছি। আমরা সব দিক থেকে প্রস্তুত হয়েছি। এই সার্বিক সক্ষমতা অর্জন আমাদের সবার জন্য গর্বের। দেশের জন্য গর্বের।