দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেওয়ায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখাকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক সহিংসতা হলে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই আশঙ্কা বাস্তব হলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে বলেও মনে করে কমিশন। এ অবস্থায় ভোটগ্রহণের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আরও অন্তত দুদফায় বৈঠকে বসতে চাইছে নির্বাচন কমিশন। ২১ ও ৩১ ডিসেম্বর ওই বৈঠক দুটি নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তফশিল ঘোষণা-পরবর্তী কর্মপরিকল্পনায়ও দুদফায় আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ওই কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের পরই প্রাথমিক ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। ফলের গেজেট প্রকাশের জন্য ৯ জানুয়ারি বিজি প্রেসে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, এ নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো অংশ না নিলে সহিংসতা বাড়তে পারে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের আশঙ্কার কথা ইসিকে জানিয়েছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার পরামর্শ এসেছে। নির্বাচনি মালামাল ও ভোটারের নিরাপত্তায় অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এটি বিবেচনায় রেখে গত নির্বাচনের তুলনায় এবার ভোটকেন্দ্রে একজন করে পুলিশ সদস্য বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া কয়েকদিনের মধ্যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাঠে নামাতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ম্যাজিস্ট্রেটরা মনোনয়নপত্র দাখিল ও মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে শোডাউন রোধ, আচরণবিধি প্রতিপালন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। ভোটগ্রহণ হবে ৭ জানুয়ারি।
আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম যুগান্তরকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে তাদের সঙ্গে কতবার বৈঠক করব সে সিদ্ধান্ত হবে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো আছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। যেহেতু তফশিল ঘোষণা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সামনে বৈঠক হবে।
ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, রেওয়াজ অনুযায়ী তফশিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। বর্তমান কমিশন তফশিল ঘোষণার আগেই এ সংক্রান্ত বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ২১ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেখানে কার কী দায়িত্ব তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের কর্মকর্তারা পৃথকভাবে সিইসির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। একইভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে একবার সমন্বয় সভা করেছে কমিশন। ওই সভায় বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দিয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা এবং তফশিল ঘোষণা থেকে ভোটগ্রহণের পর পর্যন্ত সময়ে সহিংসতা এড়াতে বাড়তি সতর্কতা হিসাবে আরও দুদফায় আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত প্রথম বৈঠকটি ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এর আগে ১৭ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় শেষ হবে। ওইদিনই চূড়ান্ত হবে নির্বাচনে কোন কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা মাঠে থাকছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে কতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন তাও জানা যাবে। চূড়ান্ত প্রার্থীদের অবস্থান ধরে নির্বাচনের নিরাপত্তা কৌশল নেওয়া হবে। ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। এ ছাড়াও উপমহাপুলিশ পরিদর্শক, পুলিশ কমিশনার, ডিসি ও এসপিদেরও ওই বৈঠকে থাকতে বলা হবে। এ নির্বাচনে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর ১০ দিন পর ৩১ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক বিশেষ সভা আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। ওই সভায় নির্বাচনি প্রচারণা পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং ভোটগ্রহণের দিনের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এবারই প্রথম পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোটগ্রহণের পরের ১৫ দিন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠে রাখার সিদ্ধান্ত রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের পরের দিনই ১৯ ডিসেম্বর নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বসার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। যদিও ১ নভেম্বর সিইসির সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় পুলিশ বাড়ছে : গত নির্বাচনের তুলনায় এবার ভোটকেন্দ্রে পুলিশের একজন করে সদস্য বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে অবস্থিত সাধারণ কেন্দ্রে একজন ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে দুজন করে পুলিশ সদস্য ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে আনসার ও গ্রাম পুলিশ মিলিয়ে ছিলেন ১৩-১৪ জন। এবার সাধারণ কেন্দ্রে দুজন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে তিনজন পুলিশ সদস্য মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে। মেট্রোপলিটন এলাকায় সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ৩ জন ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ৫ জন পুলিশ ছিল। সেখানেও একজন করে পুলিশের সদস্য বাড়ানো হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪০ হাজার ১৯৯টি ভোটকেন্দ্র ছিল। এবার কমবেশি ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্র ধরা হয়েছে। ভোটের ২৫ দিন আগে চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্রের গেজেট প্রকাশ করা হবে।
ফল প্রকাশের পরিকল্পনা : নির্বাচনের বিভিন্ন ধাপের কার্যক্রম বাস্তবায়নে ১ নভেম্বর থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত কখন কী ধরনের পদক্ষেপ ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে তার কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। এতে কখন কোন বিষয়ে পরিপত্র জারি করা হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের পর সেদিনই তা প্রকাশ করবে ইসি। একইসঙ্গে প্রাথমিক ফলাফল ইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশের ব্যবস্থা করা হবে। নির্বাচিত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য ৯ জানুয়ারি বিজি প্রেসে পাঠানো হবে। ১০ জানুয়ারি নবনির্বাচিতদের গেজেট সংসদ সচিবালয়ে পাঠানো হবে। এরপর সংসদ সচিবালয় তাদের শপথের আয়োজন করবে।