বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : নীলফামারীর বাণিজ্যিক শহর সৈয়দপুরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিপ্লব ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাফল্য অর্জন করেছে ঝুট কাপড়ের ক্ষুদ্র গার্মেন্টস শিল্প। উদ্যোক্তাদের মেধা ও শ্রমে এসব গার্মেন্টসের তৈরি পোশাক এখন ভারত, নেপাল ও ভুটানে যাচ্ছে। পোশাকগুলো রপ্তানি করে আয় করছেন কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। ঝুট কাপড়কে ঘিরে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র কারখানাগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১০ হাজার পরিবারের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সৈয়দপুরে ঝুট কাপড়ের ব্যবসা পাকিস্তান আমল থেকে। তবে কে প্রথম শুরু করেছিলেন তা নির্দিষ্ট করে কেউ
বলতে পারেন না। শুরু থেকেই ঝুট কাপড় থেকে তৈরি হচ্ছে নানা রকম পোশাক। এর পরিধি বেড়ে যায় ২০০২ সালে। মূলত চাহিদার প্রেক্ষাপটে এই সময়ে গড়ে ওঠে রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক গ্রুপ। ব্যবসায়ীরা ঢাকার মিরপুর, কালীগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানের পোশাক কারখানাগুলো থেকে ঝুট কাপড় কিনে আনেন। পাশাপাশি সুতা, বোতাম, ইলাস্টিক, প্যান্টের
পকেট বানানোর স্টিকার, পুরনো সেলাই মেশিনও সংগ্রহ করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ঝুট কাপড় থেকে কারখানাগুলোয় তৈরি হচ্ছে ট্রাউজার, শর্টস (হাফ প্যান্ট), জ্যাকেট, টি-শার্ট, জিনস প্যান্টসহ নানা ধরনের পোশাক। দেশের চেয়ে এই পোশাকগুলোর চাহিদা ভারত, নেপাল ও ভুটানে বেশি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ঝুট কাপড় ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বাচ্চু মিয়া বলেন, মূলত বিক্রমপুর থেকে এসে যারা সৈয়দপুরে স্থায়ী আবাস গড়েছেন, তাদেরই হাত ধরে এই ঝুট কাপড়ের ব্যবসা শুরু। পরবর্তীকালে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে প্রতিকেজি ব্লেজারের ঝুট ৭০ থেকে ১২০ টাকা, জ্যাকেট তৈরির ঝুট ৯০ থেকে ১৬০ টাকা, গ্যাবার্ডিন প্যান্টের ঝুট ৯০ থেকে ১৭০ টাকা, জিনসের ঝুট ৯০ থেকে ২০০ টাকা দরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে কিনে আনা হয়। এর পর এসব ঝুট কাপড় দিয়ে নানা ধরনের পোশাক তৈরি করে শ্রেণি ভেদে ২০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পোশাকের বড় পাইকারি বাজার গড়ে উঠেছে শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ সড়কে। এখান থেকে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো ছাড়াও দেশের অন্যান্য জেলা ও উপজেলার ব্যবসায়ীরা এসে ঝুট কাপড় দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পোশাক কিনে নিয়ে যান।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শহরের বাঁশবাড়ি, সাহেবপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, মুন্সীপাড়া, গোলাহাট, নতুনবাবু পাড়া, হাতিখানা, প্লাজার সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলা, বোতলাগাড়ীসহ আটকেপড়া পাকিস্তানি ২২টি ক্যাম্পে গড়ে উঠেছে এসব ক্ষুদ্র পোশাক কারখানা। প্রতিটি কারখানায় সর্বনিম্ন পাঁচটি থেকে সর্বোচ্চ ৫০টি মেশিনে শ্রমিকরা দিন-রাত কাজ করছেন।
মিস্ত্রিপাড়ার একটি গার্মেন্টস কারখানায় কর্মরত শ্রমিক শরিফা বেগম জানান, তার স্বামী রিকশা চালিয়ে যে আয় করত তা দিয়ে পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। এখন সেলাইয়ের কাজ করে তিনি প্রতিদিন গড়ে ৪০০ টাকা আয় করছেন। ফলে স্বামী-স্ত্রীর আয়ে সংসারে ফিরে এসেছে সচ্ছলতা। এখানে গড়ে ওঠা পাঁচ শতাধিক ক্ষুদ্র গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে অন্তত ১০ হাজার পরিবারের মুখে হাসি ফুটেছে।
শহরের গার্ডপাড়া এলাকার ক্ষুদ্র গার্মেন্টস কারখানার মালিক মো. ওমর ফারুক বলেন, মহামারী করোনার কারণে দুই শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এবার শীত ঘিরে এসব কারখানা আবার চালু হয়েছে। এ ছাড়া ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে অর্ডার আসছে। ফলে ব্যস্ত সময় পার করছে কারখানাগুলো।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইনভেন্ট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের মালিক হুমায়ুন কবির বলেন, সৈয়দপুর ও পাবনায় তার ঝুট কাপড়ের কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার তৈরিকৃত ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি-শার্ট ভারত, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানি করেন তিনি। বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করা হয়।
এম আর ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার মো. মতিয়ার রহমান দুলু বছরে ৫ লাখ ডলারের ট্রাউজার, হাফ প্যান্ট ও টুপি ভারত, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানি করেন বলে জানান। অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আরএস ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ফাইয়াজুল হক সাজু বলেন, তিনি প্রতিবছর গড়ে ১০ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করে থাকেন।
সৈয়দপুরে গড়ে ওঠা রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক গ্রুপের সভাপতি মো. আকতার হোসেন খান বলেন, এখানে ঝুট কাপড়কে ঘিরে ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক কারখানা থাকলেও রপ্তানি লাইসেন্স রয়েছে মাত্র সাতজনের। তিনি সম্ভাবনাময় এ খাতে কম সুদ ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি জানান।
নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি প্রকৌশলী শফিকুল আলম ডাবলু ঝুট কাপড়ের পোশাক শিল্পকে নীলফামারী তথা উত্তরের আশীর্বাদ উল্লেখ করে বলেন, যেহেতু ঝুট কাপড়ের পোশাকগুলো বিদেশের বাজারে ঠাঁই পেয়েছে। সে কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও প্রসারকল্পে চিলাহাটিকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। পাশাপাশি সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করারও দাবি জানান তিনি। এ ব্যাপারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর আশু সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।