বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসাবে সারাবিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহন ও বাস্তবায়নে অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সরকারের ১০টি বৃহৎ প্রকল্পের সুফল নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদন-
দেব দুলাল মিত্র : বর্তমান সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ অন্যতম। বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু টানেল একটি মাইলফলক অর্জন। গত ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলটি উদ্বোধন করেন। পদ্মা সেতুর পর বঙ্গবন্ধু টানেল বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাতে দ্বিতীয় ‘ড্রিম প্রজেক্ট’ হিসাবে পরিচিত। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে যানবাহন চলাচলকারী প্রথম টানেল। এই টানেল উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ টানেল যুগে প্রবেশ করেছে।
কর্নফুলী নদী চট্টগ্রাম মহানগরকে দুই ভাগে ভাগ করে রেখেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেল অনুসরণ করে টানেল নির্মাণের নির্দেশ দেন। নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয় চীনকে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। কর্ণফুলীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি টানেলটি তৈরি করে। মূল টানেলের মোট দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। ৩৫ ফুট প্রস্থ ও ১৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দুইটি টিউব স্থাপন করা হয়েছে। এই টিউিবের ভেতর দিয়েই যানবাহন চলাচল করছে।
দুই টিউিবের মাঝখানে ১১ মিটার দূরত্ব রয়েছে। এরফলে ভারি যানবাহন সহজেই টানেলের মধ্য দিয়ে চলাচল করবে। টানেলের সঙ্গে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারের অ্যাপ্রোচ রোড রয়েছে। পাশাপাশি ৭২৭ মিটারের একটি ওভারপাসও রয়েছে- যা মূল শহর, বন্দর এবং নদীর পশ্চিম দিককে পূর্ব দিকের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এই টানেল এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে। চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা বাড়বে এবং গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ আরো ত্বরান্বিত করবে। টানেলটি ভূমিকম্প ও জলোচ্ছ¡াস প্রতিরোধে সক্ষম। সর্বোপরি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নতুন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।
যৌথ অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল। ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটি নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে এটি বাস্তবায়ন হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং চীন সরকার ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে। মূল টানেল নির্মাণ কাজের শতভাগ খরচ বহন করেছে চীন সরকার।
অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের অর্থনীতির গতি আরো বাড়াতে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। টানেলটি ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উভয় পাশের দুই বড় অর্থনৈতিক করিডোরকে যুক্ত করবে। চট্টগ্রামকে বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। টানেলটি চালু হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে। নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। ইতোমধ্যেই ১০০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে; যার মধ্যে ২০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।
আনোয়ারা উপজেলার মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আগে আনোয়ারা উপজেলা থেকে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগত। এখন মাত্র ১৫ মিনিটেই আনোয়ারা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। ওই এলাকায় গড়ে উঠতে শুরু করেছে অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ নানান স্থাপনা। টানেল চালু হওয়ার পর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, কর্ণফুলী নদী তীর ও আনোয়ারা উপজেলার পার্কি সমুদ্র সৈকত ঘিরে পর্যটনের প্রসার বেড়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এসব এলাকা এখন পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠছে। ১০টি আধুনিক হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর, কর্ণফুলী উপজেলায় কোরিয়ান ইপিজেড, আনোয়ারা উপজেলায় চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজারের মহেশখালীতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রর বিকাশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। বঙ্গবন্ধু টানেল সামগ্রিকভাবে মোট দেশজ উৎপাদন শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে বলেও বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
বেপজার এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাশে আড়াই হাজার একর জমিতে কোরিয়ান ইপিজেডের ৩৮ কারখানা বঙ্গবন্ধু টানেলের সুবিধা পাবে। বর্তমানে কোরিয়ান ইপিজেড প্রতি বছর দেড় থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। কোরিয়ান ইপিজেডের পাশেই চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। ২০১৬ সালে আনোয়ারায় ৭৫৩ একর জমিতে এই জোনের উদ্বোধন করা হয়। ভূমির শতভাগ ব্যবহার করা হলে এবং সম্পূর্ণ জোনটি চালু হলে ৩৭১টি কারখানা হবে। তখন কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বিশাল কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন বিকাশে ব্যাপক অবদান রাখছে বঙ্গবন্ধু টানেল। দেশের অন্যতম পর্যটন শহর কক্সবাজারের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগে সময় সাশ্রয় হচ্ছে। কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিনগামী যাত্রী ও পণ্য পরিবহনকারী যানবাহনগুলোর বেশির ভাগই এখন সময় সাশ্রয়ের জন্য বঙ্গবন্ধু টানেল ব্যবহার করছে। প্রতিদিনই এই টানেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের ফলে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে। আগের চেয়ে ১ ঘণ্টা আগে কক্সবাজারে পৌঁছানো সম্ভব হবে।