বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : রেমিট্যান্স প্রবাহে গতি বেড়েছে। রফতানি আয়ে এখন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও ঠেকানো গেছে। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অর্থনীতিতে আরও গতিসঞ্চার হতে পারে। ভোটের পর থেকে অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার, ব্যবসায়ী ও জনগণ সবার মনোযোগ এখন নির্বাচনের দিকেই। তাই সরকারের মূল লক্ষ্যও এখন নির্বাচন। আর্থিক খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার নতুন সরকার করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও সম্প্রতি মন্তব্য করে বলেছিলেন, নির্বাচনের পর ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, প্রতিবার ইলেকশনের আগে এরকম হয়। আমরা দেখি একটা অনিশ্চয়তা থাকে। ইলেকশনের পর যখন নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, আপনারা দেখবেন যে খুব দ্রুত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। আমাদের ধারণা আগামী জুনের মধ্যে অর্থনীতি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবে ইনশাআল্লাহ।
সে সময় রিজার্ভ প্রসঙ্গে গভর্নর আরও বলেন, নির্বাচনের পরে বিদেশি ঋণ এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে থাকবে, ট্রেড ক্রেডিটও বাংলাদেশ পেতে থাকবে। ফলে যেটা হবে, আবার এটা (রিজার্ভ) পজিটিভ হবে। জুনের মধ্যে রিজার্ভ আবার বিল্ডআপ হতে শুরু করে করবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়াকেও ইতিবাচকভাবে দেখছেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তি আসায় সরাসরি রিজার্ভ পতন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। এছাড়া পরোক্ষভাবে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সাধারণত আইএমএফের ঋণ ছাড় বা মূল্যায়ন অন্যান্য দাতা সংস্থা অনুসরণ করে। ফলে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকেও কিছু ঋণ পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির এই ঋণের পরিমাণ তত বেশি না। তারপরও ঋণের এই কিস্তিটা রিজার্ভের কিছুটা উন্নতি হবে। তার মতে, আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ পাওয়া বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে। কারণ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে আস্থা ফেরাতে সহায়ক হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
গত সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে ১৫১ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার। বর্তমানে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ২ হাজার ৬৮ কোটি ১০ হাজার মার্কিন ডলার (বিপিএম৬) বা ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ১৪ ডিসেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯১৬ কোটি ৯০ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার (বিপিএম৬) বা ১৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণসহ অন্যান্য উৎস থেকে ডলার যোগ হওয়ায় রিজার্ভের এই পরিমাণ বেড়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮৯ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করে। এর দুই দিন পর ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে এ ডলার যোগ হয়। একই দিনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের ৪০০ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। অন্যান্য উৎস থেকেও আরও রিজার্ভ জমা হয়।
রেমিট্যান্স প্রবাহ
গত নভেম্বরের মতো চলতি ডিসেম্বরেও স্বস্তির হাওয়া লেগেছে রেমিট্যান্সের পালে। শুধু তাই নয়, গত মাসের তুলনায় এই মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ কোটি ডলার বেশি পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। চলতি মাসের প্রথম ২২ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৬ কোটি ৯৪ লাখ মার্কিন ডলার। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে দেশে এসেছে ৭ কোটি ১৩ লাখ ডলার। ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত নভেম্বরের প্রথম ২৪ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৯ কোটি ২৯ লাখ (দৈনিক ৬ কোটি ২২ লাখ) মার্কিন ডলার। অক্টোবরের প্রথম ২৭ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৬ কোটি ৭১ লাখ (দৈনিক ৬ কোটি ১৭ লাখ) মার্কিন ডলার। আর সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ (দৈনিক ৪ কোটি ৪৮ লাখ) ডলার রেমিট্যান্স।
রফতানি আয়
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দেশে রফতানি আয় এসেছে ২ হাজার ২২৩ কোটি ২২ লাখ মার্কিন ডলারের। এই রফতানি আয় এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৯৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, আলোচ্য সময়ে প্রধান রফতানি পণ্য পোশাক খাত থেকে ১ হাজার ৮৮৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের আয় পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নিট পোশাক (সোয়েটার, টি-শার্ট জাতীয় পোশাক) রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৯৯ কোটি ডলার সমমূল্যের এবং ওভেন পণ্যের (শার্ট, প্যান্ট জাতীয় পোশাক) রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৮৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর সময়ে বাংলাদেশ পোশাক রফতানি করে আয় করেছে ৪২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর মুখপাত্র ও পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এই ১১ মাসে ইউরোপে পোশাক রফতানি বেড়েছে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ, আর যুক্তরাষ্ট্রে কমেছে ৯ শতাংশ। তবে অপ্রচলিত বাজারে রফতানি বেড়েছে ২২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ অপ্রচলিত বাজারে প্রবৃদ্ধির কল্যাণেই সার্বিক রফতানিতে এখনও কিছুটা প্রবৃদ্ধি বজায় আছে। ২০২৪ সালটি কেমন যাবে, এটা বলা কঠিন, কারণ একদিকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি কোথায় যায়, সেটি আমাদের দেখতে হবে। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাপ্লাই চেইন, মূল্যস্ফীতি, ইত্যাদি। সেই সঙ্গে আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থিনীতিতেও কিছু চাপ তৈরি হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়বে বলে আমরা ইঙ্গিত পাচ্ছি। আমরা যদি আমাদের অভ্যন্তরীণ সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে পারি আর নতুন পণ্য ও বাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবো।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে নানা সংকট দেখা যাচ্ছে। ডলার পাচার থেকে শুরু করে হরতাল-অবরোধ কিংবা আন্দোলন কর্মসূচির কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতি এবং বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া এর অন্যতম। এছাড়া অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু সিদ্ধান্তও আটকে থাকে নির্বাচন শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। সাধারণত দেখা যায়, নির্বাচনের আগে অর্থনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, নির্বাচনের আগে সব সময়ই অর্থনীতিতে সংকট থাকে, এবার এই সংকট অনেক বেশি। তিনি মনে করেন, অর্থনীতির এই সংকট নিরসনে ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। সেটা হয়তো ইলেকশনের পর করতে হবে। ডলার সংকট ছাড়াও মূল্যস্ফীতি, সুদের হার এবং সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো সামলাতে যেসব বড় পদক্ষেপ দরকার, এগুলো নির্বাচনের পর করতে হবে।
সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নির্বাচন ও রাজনীতির প্রভাব আছে। অনেক ক্ষেত্রে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নির্বাচন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আটকে থাকে। যেটা নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে অর্থনীতিতে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার মনে করেন, নির্বাচনের পর বাংলাদেশের ওপর আস্থা বাড়লে বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসবে, বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় হবে এবং ডলারের রেট কমলে বাংলাদেশের শর্ট টার্ম ক্রেডিট ও ট্রেড ক্রেডিট বাড়লেই অর্থনীতিতে বাউন্স ব্যাক শুরু হবে।
সম্প্রতি ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় গভর্নর বলেন, অর্থনীতি বাউন্স ব্যাক করলেই এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বাভাবিক হলে এক্সচেঞ্জ রেট পুরোপুরি মার্কেট বেজড করা হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকার স্থানীয় উন্নয়নে আর এক ডলারও বিনিয়োগ করবে না বলে জানান আব্দুর রউফ।
নির্বাচনের পর দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, প্রধান কারণ হলো আস্থা। বিদেশি পার্টের এফডিআই গত বারের তুলনায় নেগেটিভ হয়ে গেছে। কারণ সবাই নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে কী হয়, তা দেখে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেবে। এখন কেউই বিনিয়োগ করতে আসছে না।
তিনি বলেন, যেসব ডেভেলপমেন্ট পার্টনারের সঙ্গে লোন সাইন হয়ে আছে, তাদের অর্থ ছাড় করার কথা। তারাও নির্বাচনের কারণে এখন অপেক্ষা করছে। আর এখন অবস্থা তো আরও খারাপ। হরতাল, অবরোধ চলছে। এই সময় বিদেশি কনসালটেন্টও আসবে না, টাকাও ছাড় করবে না।
ইউএস ইন্টারেস্ট রেট এখন স্থিতিশীল আছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা পরবর্তী সময়ে ইন্টারেস্ট রেট কমানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। মারাকাসে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বোর্ড সভায় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি ও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেছেন, এই বছর শেষে ইন্টারেস্ট রেট ২ দশমিক ৫ শতাংশে নামবে এবং আগামী মার্চের মধ্যে এটা ২ শতাংশে নেমে আসবে। তাদের এই বক্তব্য থেকে আমরা ধরে নিছি যে, মার্চের পর থেকে এসওএফআর রেট কমে আসবে। আর এসওএফআর রেট একবার কমা শুরু করলে মার্কিন ডলার আমাদের এখানে আসা শুরু করবে। তখন আমাদের ট্রেড ক্রেডিটও বাড়তে থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আরও বলেন, তাই নির্বাচনের পর এফডিআই আসবে বলে আমরা খুবই নিশ্চিত। নির্বাচনের পর আমাদের ওডিএ ডিজবার্সমেন্ট বাড়বে। ডলারের রেট কমালে মার্চের পরে বাংলাদেশের শর্ট টার্ম ক্রেডিট ও ট্রেড ক্রেডিট বাড়তে থাকবে। তাই মার্চ থেকে আমাদের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট পজিটিভ হতে শুরু করবে।