বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য কঠোর অবস্থানে রয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিরোধীদের বর্জনের মুখে নির্বাচন দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করার জন্য ব্যাপক তৎপর সংস্থাটি। সম্মানজনক ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে যা করার সবই করছে কমিশন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচন নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানামুখী চাপের মধ্যে রয়েছে কমিশন। সেজন্য নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর দীর্ঘদিনের চাপ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর। নির্বাচন কেন্দ্র করে এরই মধ্যে বাংলাদেশের
জন্য নতুন ভিসা নীতিও চালু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে ভোটের পর আরও নতুন নতুন পদক্ষেপের গুঞ্জন রয়েছে বিভিন্ন মহলে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের বক্তব্যেও ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নানা শঙ্কার কথা ফুটে উঠেছে।
সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ভোটে না আসায় শুরুতে অংশগ্রহণমূলক ভোটের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বাইরেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সবার দলের সবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ায় প্রার্থী সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে তেমনি সারা দেশে ভোটের একটি উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের ছাড়াই অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ ভোটে ভোটারদের উপস্থিতির সম্মানজনক হার নিশ্চিত করে বহির্বিশ্বের চাপ থেকে মুক্ত হতে চায় নির্বাচন কমিশন। এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সম্প্রতি বলেছেন, ‘এবারের নির্বাচনে বিদেশি শক্তির থাবা পড়েছে। সেজন্য দেশের স্বার্থে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের কোনো বিকল্প নেই।’ গত রোববার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যাত্রা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। জনগণ ও বহির্বিশ্বের কাছে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
একই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘শুধু আমাদের দৃষ্টিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করলে হবে না। আমাদের দিকে সমগ্র বিশ্ব তাকিয়ে আছে। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু, সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য না করতে পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাংলাদেশে সব বিষয়—বিশেষ করে আর্থিক, সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব কিছু থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশ হয়তো বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সেজন্য নির্বাচনকে যে কোনো মূল্যে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করতে হবে।’
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনে ২ হাজার ৭১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়েন ৭৩১ জন। ১ হাজার ৯৮৫ জনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়। তবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে ৫৬০টি আপিল আবেদন জমা পড়ে। আপিল শুনানির মধ্য দিয়ে ২৭৫ জন তাদের প্রার্থিতা ফিরে পান। আর রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বাছাইয়ে বৈধ ৫ জনের প্রার্থিতা আপিলে বাতিল হয়ে যায়। আর ২৮৫টি আপিল আবেদন নামঞ্জুর করে নির্বাচন কমিশন। ফলে শেষ পর্যন্ত বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ২৬০টিতে। নির্দিষ্ট দিনে মনোনয়ন প্রত্যাহার শেষে মোট প্রার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৯৬ জনে। এর মধ্যে ভোটে অংশগ্রহণকারী ২৭টি দলের বাইরে ৩৮২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছেন। পরে উচ্চ আদালত এবং আপিল বিভাগের রায়ে কয়েকজন প্রার্থিতা ফিরে পান এবং কয়েকজনের প্রার্থিতা বাতিলও হয়। নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত রয়েছে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা, যা চলবে আগামী ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। আর ৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সারা দেশে একযোগে ভোট গ্রহণ করা হবে। এরই মধ্যে ভোটের দিন উপলক্ষে ওইদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপিসহ নিবন্ধিত ১৬টি রাজনৈতিক দল ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ভোট ঠেকানোর আন্দোলনে মাঠে রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, এবারের নির্বাচন নিয়ে ত্রিমুখী চাপে রয়েছে কমিশন। বিরোধীদের বর্জন ও ঠেকানোর ঘোষণার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে চলমান সংঘাত-সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়িয়ে দেশ-বিদেশে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করাই ইসির জন্য চরম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে জনগণ ও দেশের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে এসব চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে যা যা করার তার সবই করা হচ্ছে। বিরোধীদের ভোট ঠেকানোর পরিকল্পনা মোকাবিলায় মাঠ প্রশাসনকে এরই মধ্যে কড়া নির্দেশ দিয়েছে ইসি। এমনকি ভোট বর্জনের লিফলেট বিতরণকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলেছে সংস্থাটি। সে অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। পাশাপাশি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সংঘাত-সহিংসতা মোকাবিলায় কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। একই সঙ্গে বেপরোয়া প্রার্থীদের লাগাম টানতে সক্রিয় রয়েছে কমিশন। এর অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত সাড়ে ৪ শতাধিক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের শোকজ, তলব ও জরিমানা করেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে নিয়মিত আদালতে। আরও মামলা প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া কমিশনে ডেকে জরিমানা করে শেষবারের মতো সতর্ক করা হয়েছে দুই প্রার্থীকে। এমনকি বেপরোয়া প্রার্থীদের থামাতে প্রার্থিতা বাতিলেরও হুমকি দিচ্ছে কমিশন। আর ভোটের দিন কেন্দ্রে উপস্থিতি বাড়াতে সারা দেশে চষে বেড়াচ্ছেন সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা। মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ও প্রার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করছেন তারা। ভোটের আগে এবং পরের সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় সাড়ে সাত লাখ সদস্য মাঠে থাকবেন।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের চাপ ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে কমিশনের। নির্বাচনে কড়া নজর রয়েছে বাইরের দেশগুলোর। ভোটে কোনো ধরনের অনিয়ম বা প্রশ্ন উঠলে কমিশন এবং সরকারের ওপর চাপ বাড়তে পারে। যা দেশে ও দেশের জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। নির্বাচন কমিশনও এ ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। তাদের কথাবার্তায় সে বিষয়টি ফুটে উঠেছে। সরকারবিরোধীদের বর্জন ও ভোট ঠেকানো ছাড়াও সারা দেশে প্রার্থীদের দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণ করে শেষ পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ ঠিক রেখে ভোটের হার বাড়িয়ে দেশ-বিদেশে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, এবারের নির্বাচন নিয়ে সব মহলের প্রশ্ন রয়েছে। কারণ নিজেদের মধ্যেই ভাগাভাগির জন্য নির্বাচন হচ্ছে। যার সব কিছু আগেই ঠিক করা। এতে সরকারবিরোধী কেউ অংশ না নেওয়ায় জনগণের আগ্রহ নেই। উন্নয়ন সহযোগী বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও এতে কড়া নজর রাখছে। সেজন্য নির্বাচনের পরই বলা যাবে—আসলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবারের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বিগত দুটি নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্কের মুখে হতে যাওয়া এ নির্বাচন বিরোধী পক্ষ বর্জন করায় শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে কমিশন। বহির্বিশ্ব এবারের নির্বাচন নিয়ে অতীতের তুলনায় বেশ সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। সেজন্য তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সব হুমকি ও আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ভোটারদের নির্ভয়ে কেন্দ্রে আনার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।
গতকাল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন করতে গিয়ে সিইসি বলেছেন, ‘নির্বাচনে যেমন ডমেস্টিক ডাইমেনশন আছে, একইভাবে আন্তর্জাতিক ডাইমেনশনও আছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক ডাইমেনশনকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। নির্বাচনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের দেখাতে হবে নির্বাচনটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।’