বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : নিরাপত্তার চাদরে পুরো দেশ : মাঠে সাড়ে ৯ লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, মনিটরিং সেলে ৩ হাজার ম্যাজিস্ট্রেট
আর মাত্র তিন দিন পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন ঘিরে একদিকে যেমন রয়েছে দেশজুড়ে উৎসবের আমেজ, তেমনি আছে প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা, হাতাহাতি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ নানান সহিংসতার ঘটনা। এছাড়া দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভোট বর্জনসহ নির্বাচন প্রতিহতের চেষ্টা করছে, বাস-ট্রেনে আগুন দেয়া, ভোটারদের ভোট দিতে নিষেধসহ চলছে সহিংসতাও। এসব কারণে ভোটারদের মধ্যে বিরাজ করছে একধরনের শঙ্কাও। সব মিলিয়ে ভোটের উত্তাপে পুড়ছে দেশ। ইতোমধ্যে সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে, শোকজ করা হয়েছে তিন শতাধিক প্রার্থীকে। জরিমানা গুনেছেন একাধিক প্রার্থী।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ করা হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। এবারের নির্বাচনে মোট সাড়ে ৪ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে ইসি। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। ইসির নির্দেশে ইতোমধ্যে দেশকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। যে কোনো ধরনের অনিয়ম কারচুপি ও সহিংসতা প্রতিরোধে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, কোস্ট গার্ড, আর্মড ফোর্স, বিমান বাহিনী, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ১০ লাখ সদস্য মাঠে চষে বেড়াচ্ছে। দেশব্যাপী চলছে সেনা, বিজিবি, র্যাব, আর্মড ফোর্সসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল। রয়েছে প্রায় হাজার-তিনেক নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মনিটরিং সেল। কোনো রকম অনিয়ম দেখলেই তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা। আগামী ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ-র্যাব ও বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে। থাকছে ইসির অধীনে সাড়ে ৯ লাখ ভোট কর্মকর্তা ও কর্মী।
ইতোমধ্যে ইসির নির্দেশে নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন, অনিয়ম, সহিংসতার বিষয়ে গত ১৫ দিনে ২১৩টি মামলা হয়েছে। উদ্ধারকৃত মোট অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা ২৪১, গ্রেপ্তারকৃত আসামির সংখ্যা ৭০০ বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তাফিজুর রহমানের সই করা পরিপত্রে বলা হয়েছে, মেট্রোপলিটন এলাকার সাধারণ ভোটকেন্দ্রে অস্ত্রসহ তিনজন
পুলিশসহ অঙ্গীভূত আনসার ১২ জন মিলে মোট ১৫ জন। আর গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে অস্ত্রসহ পুলিশ ৪ জন ও অঙ্গীভূত আনসার থাকবে ১২ জন, যার মধ্যে একজন অস্ত্রধারী, মোট ১৬ জন। বিশেষ এলাকার ভোটকেন্দ্রে (পার্বত্য ও দুর্গম এলাকায়) অস্ত্রসহ পুলিশ ২ জন, অঙ্গীভূত আনসার ১২ জন থাকবে, আর গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে অস্ত্রসহ পুলিশ ২ ও অঙ্গীভূত আনসার ১২ জন, গ্রাম পুলিশ থাকবে ২ জন। অন্যদিকে এসব এলাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে অস্ত্রসহ পুলিশ ৩ জন, অঙ্গীভূত আনসার ১২ জন আর গ্রাম পুলিশ থাকবে ২ জন, মোট ১৭ জন।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, এবার ৫ লাখ ১৬ হাজার আনসার সদস্য, ১ লাখ ৮২ হাজার পুলিশ, ৯১ হাজার র্যাব সদস্য, ২ হাজার ৩৫০ কোস্ট গার্ড সদস্য, ১ হাজার ১৫১ প্লাটুন বিজিবি এবং ৬২ প্লাটুন সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন থাকবে। নির্বাচনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার লক্ষ্যে নৌবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। আগামী ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় জেলার ১৯টি উপজেলায় নৌবাহিনীর ছয়টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন থাকবে। ভোটের আগেপরে ১০-১৫ দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনী টহল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
তিনি জানান, সেনা ও বিজিবি মূলত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতাযেন থাকবে। তারা কেন্দ্রের বাইরে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। র্যাব টহল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নির্বাচনী এলাকার সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবে। প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে হেলিকপ্টার ও ডগ স্কোয়াড। র্যাবও চাহিদা অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রের ভেতরে বা ভোট গণনাকক্ষের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করবে। সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের অনুরোধে ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাহিনীগুলো এলাকাভিত্তিক মোতায়েন করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী ৬২টি জেলায় ও উপকূলীয় দুটি জেলা ভোলা ও বরগুনাসহ মোট ১৯টি উপজেলায় নৌবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫টি উপজেলায় বিজিবি এককভাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং সীমান্তবর্তী ৪৭টি উপজেলায় সেনাবাহিনী বিজিবির সঙ্গে ও উপকূলীয় চারটি উপজেলায় কোস্ট গার্ডের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করবে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হেলিকপ্টারের সহায়তায় দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা দেবে। বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বিশেষ এলাকা ও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধি ও অন্যান্য আইনের বিধান এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ‘ইনস্ট্রাকশন রিগার্ডিং এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ারের’ বিধান অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালিত হবে। রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজন অনুসারে উপজেলা বা থানায় সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহায়তা করবে।
আর উপকূলবর্তী এলাকায় নৌ-বাহিনী প্রয়োজন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে। ঝুঁকি বিবেচনায় রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রতিটি জেলায় নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কম বা বেশি করা যাবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দেশক্রমে তারা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বা মহাসড়কগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। বিমান বাহিনী প্রয়োজনীয় সংখ্যক হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও বাহিনীগুলোর অনুরোধে ওড়াতে সহায়তা করবে।
নির্বাচনী এলাকা ও ভোটকেন্দ্রের ভেতরে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং ভোটারদের জন্য আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে দায়িত্ব পালন করবে পুলিশ। নির্বাচনী সরঞ্জাম ও দলিল-দস্তাবেজ বহনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। নির্বাচন কর্মকর্তা-কর্মচারী, নির্বাচন কার্যালয়, রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের নিরাপত্তা বিধান করবে পুলিশ। সেই সঙ্গে পুলিশ স্থানীয় জননিরাপত্তা, কেন্দ্রে ভোটারদের সুশৃঙ্খল লাইন করানোসহ স্থানীয় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে।
আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ : নির্বাচন সামনে রেখে গত শনিবার থেকে আগামী ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত লাইসেন্সধারী ব্যক্তিদের আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও প্রদর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত শুক্রবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইসরাত জাহানের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামীকাল ৫ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে ৮ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে। এছাড়া ৬ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে ৭ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত ট্যাক্সি, মাইক্রোবাস, পিকআপ ভ্যান, ট্রাক, লঞ্চ, ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল করতে পারবে না। ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে ৯ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে। এদিকে ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে কোনো প্রার্থী নির্বাচন ক্যাম্প স্থাপন করতে পারবে না।
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, বিগত দুটি নির্বাচন কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এবারে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে আমরা বদ্ধ পরিকর। আমাদের যত আয়োজন, সব নির্বাচন ঘিরেই। তাই নির্বাচনের পরিবেশ সুন্দর রাখতে নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ সব বাহিনী নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশিরাও আমাদের নির্বাচন সুষ্ঠু দেখতে চায়। তাই নির্বাচন যে কোনো প্রকারে গ্রহণযোগ্য, ফ্রি, ফেয়ার হতেই হবে। নিরাপত্তার কোন ঘাটতি থাকবে না, কেউ কর্তব্যে গাফিলতি করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে অনিয়ম হলেই তাৎক্ষণিক অ্যাকশনে যাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা। নির্বাচনে যেখানেই অনিয়মের অভিযোগ আসবে সেখানেই তাৎক্ষণিক অ্যাকশন নেবে নিরাপত্তা বাহিনী। তিনি বলেন, নির্বাচনের মাঠ আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। কোনো অনিয়ম পেলে আপনারা (সাংবাদিক) ছবি তোলেন, প্রমাণ দেন, আমরা সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নেব। যেখানেই অনিয়ম সেখানেই আমাদের অ্যাকশন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কারণে প্রার্থিতা বাতিলের মতো ঘটনাও ঘটেছে। আপনারা দেখেছেন এর আগে আমরা গাইবান্ধায় ভোটও বন্ধ করেছি।
নির্বাচনের নিরাপত্তাব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। তিনি বলেন, সব নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়, তারা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে থাকে। বিজিবিও রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রচুর পুলিশ, র্যাব, আনসার মাঠে আছে। কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের চেষ্টায় কোনো ত্রæটি থাকছে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। এবার নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা, কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্বে থাকবে তাদের শুধু নির্দেশ দিলেই হবে না, ইসির নির্দেশ মানতে বাধ্য করতে হবে।
যদিও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) ড. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিকভাবে অনেক ক্ষমতা দেয়া আছে, তার সঠিক প্রয়োগ দেখছি না। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নামালে হবে না, তারা ঠিকমতো নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তারা যদি কোনো দল বা প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সেজন্য ইসিতে মনিটরিং করতে হবে, যারা দায়িত্বে অবহেলা করবে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শুধু শোকজে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। ভোটাররা যাতে নির্বিঘেœ ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে সেটা ইসিকেই নিশ্চিত করতে হবে।