বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রতি বছরই বিদ্যুৎ ও সার খাতে বড় অংকের ভর্তুকি দিয়ে থাকে সরকার। তবে অর্থ সংকটের কারণে এবার সরকারের বিপুল অংকের ভর্তুকির অর্থ বকেয়া পড়েছে। এতে করে বিপাকে পড়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অবস্থায় ভর্তুকির অর্থ পরিশোধের জন্য বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে সারে ভর্তুকির বিপরীতে বেশকিছু বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। আজ বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির অর্থের বিপরীতে দুই ব্যাংকের অনুকূলে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি বন্ড ইস্যুর জন্য সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির জন্য ১২ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিল বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। সরকারের কাছে বিল বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে ব্যাংকগুলোকে বিপদে পড়তে হবে। কারণ দেশের বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাংকগুলোর বড় অংকের অর্থায়ন রয়েছে। এ অবস্থায় বিশেষ বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ও ব্যাংকগুলোকে সাময়িক স্বস্তি দিতে চাইছে সরকার। এজন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ঋণের বিপরীতে ১২ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হতে পারে। এ অর্থের পরিমাণ কিছুটা কমতেও পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোর অনুকূলে বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রথমে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করবে। ব্যাংকগুলো সেই বন্ড কিনে নেবে। ব্যাংকের কাছ থেকে বন্ড কেনা বাবদ সরকার যে টাকা পাবে, সেটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে পরিশোধ করে দেবে। তখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সে অর্থ আবার ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করে দেবে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণগুলো খেলাপি হওয়ার হাত থেকে বেচে যাবে এবং এর বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে না। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো বন্ডের অর্থের সমপরিমাণ বিধিবদ্ধ জমার (এসএলআর) বাধ্যবাধকতাও পূরণে ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়া ব্যাংকগুলো এ বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা রেখে রেপোর মাধ্যমে তারল্য সুবিধাও নিতে পারবে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বকেয়া বিলের পুরো অর্থ না পেলে বন্ডের সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যয় করতে পারবে এবং এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় কমে আসবে ও খেলাপি হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ভর্তুকির বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর সুবিধার তুলনায় অসুবিধাই বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, শুধু বিদ্যুৎ খাতের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে এর বিপরীতে যে পরিমাণ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হতো সেটি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু যে পরিমাণ অর্থ বন্ড হিসেবে ইস্যু করা হবে সেটি অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হলে আরো বেশি হারে সুদ পাওয়া যেত। এমনকি সরকারের সাধারণ ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করলেও বিশেষ বন্ডের চেয়ে বেশি হারে সুদ পাওয়া যেত। অন্যদিকে বিশেষ বন্ডের বিপরীতে ৮ শতাংশ সুদ পাওয়া যাবে এবং রেপোর মাধ্যমে তারল্য সুবিধা নিলেও একই পরিমাণ সুদ দিতে হবে। এক্ষেত্রেও সমান সমান। তাছাড়া ভবিষ্যতে নীতি সুদহার কমে গেলে বিশেষ বন্ডের সুদহারও কমে যাবে। কিন্তু অন্য যেকোনো মেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করা হলে নির্ধারিত হারে এর চেয়ে বেশি সুদ আসত।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে আজ বেসরকারি খাতের দুই ব্যাংক সিটি ব্যাংক পিএলসি ও পূবালী ব্যাংক পিএলসির অনুকূলে ২ হাজার ৬০ কোটি ৫৭ লাখ টাকার বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হবে। এর মধ্যে সিটি ব্যাংকের অনুকূলে ইস্যু করা হবে ১ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকার বন্ড। ব্যাংকটির বিদ্যুৎ খাতের ২৩টি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে এ বন্ড ইস্যু করা হবে। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, সিটি ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে এমওইউ স্বাক্ষরিত হবে। বন্ডের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ বছর এবং সুদের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার অনুসারে নির্ধারিত হবে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার ৮ শতাংশ। ভবিষ্যতে নীতি সুদহার বাড়া-কমার সঙ্গে বন্ডের সুদহারও পরিবর্তিত হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাশরুর আরেফিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভর্তুকির অর্থ পরিশোধে সরকারের এ উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আমাদের যেসব শর্ত ছিল, সেগুলো পূরণ করেই এ বন্ড ইস্যু করা হচ্ছে। তবে ভর্তুকির পুরো অর্থ বন্ড হিসেবে ইস্যু করা হলে ব্যাংকের নগদ প্রবাহে সমস্যা হতে পারে। তাই আমরা চাই ভর্তুকির অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছু বন্ড ও কিছু নগদে পরিশোধ করা হোক।’
পূবালী ব্যাংকের অনুকূলে ইস্যু করা হবে ৭৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বন্ড। ব্যাংকটির বিদ্যুৎ খাতের দুটি গ্রাহকের বিপরীতে এ বন্ড ইস্যু করা হবে। এক্ষেত্রে বন্ডের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ বছর এবং নীতি সুদহার অনুসারেই বন্ডের সুদহার নির্ধারণ করা হবে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভর্তুকির অর্থ আটকে থাকার কারণে গ্রাহকরা বিপদে পড়তে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় বন্ডের মাধ্যমে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধের উদ্যোগ নেয়ার কারণে গ্রাহকেরা স্বস্তি পাবে। ব্যাংকও এতে উপকৃত হবে।’
এর আগে ৫ ব্যাংকের অনুকূলে সার খাতের ভর্তুকি বাবদ ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি বন্ড ইস্যু করেছে সরকার। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংককে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি, জনতা ব্যাংককে ১ হাজার ৮৯৬ কোটি, ইসলামী ব্যাংককে ২ হাজার কোটি, আইএফআইসি ব্যাংককে ৪৫৯ কোটি এবং সিটি ব্যাংকের অনুকূলে ৩৯৭ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে সারে ১০ হাজার ৫০০ কোটি ও বিদ্যুতে ১২ হাজার কোটি টাকা মিলিয়ে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করতে চায় সরকার। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সংখ্যা ৪০টি। এর মধ্যে সারের ভর্তুকি বাবদ ১০টি ব্যাংক ও বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ ৩০টি ব্যাংকের অনুকূলে বন্ড ইস্যু করার পরিকল্পনা রয়েছে। বন্ডের মেয়াদ বিভিন্ন সময়ের জন্য নির্ধারণ করা হবে যাতে করে কোনো একক অর্থবছরে সরকারের ওপর একসঙ্গে খুব বেশি পরিমাণে অর্থ পরিশোধের চাপ তৈরি না হয়। বন্ড ইস্যুর ফলে সরকারের ঋণ ও দায় আরো বাড়বে। তবে এ মুহূর্তে অর্থ সংকট থাকায় সরকারের কাছে এর বাইরে আর কোনো বিকল্প নেই জানান তারা।
আইপিপি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে সাময়িকভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কিছু দায় কমলেও তাদের তারল্য সংকট পুরোপুরি কাটবে না। কারণ যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে সেগুলোর বিপরীতে বন্ড ইস্যু করা হবে। কিন্তু এখনো যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়নি কিন্তু কয়েক মাস পর হবে সেগুলো কীভাবে পরিশোধ করা হবে? তাছাড়া সামনে পিক সিজনের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য আগেভাগেই তেল কিনতে হবে। বকেয়া বিল পরিশোধ করা না হলে তেল কেনার অর্থ সংস্থান করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পরিচালন ব্যয় মেটানোর জন্যও অর্থের প্রয়োজন। সব মিলিয়ে বন্ডের মাধ্যমে সাময়িক স্বস্তি আসলেও এটি কোনো টেকসই সমাধান নয়।
এ বিষয়ে কনফিডেন্স পাওয়ার হোল্ডিং লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভর্তুকির অর্থ সরকারের অনিবার্য ব্যয় এটি পরিশোধ করতেই হতো। বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ভর্তুকির কিছু অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেটি ঠিক আছে। তবে এটি নিয়মিত চর্চা হওয়া উচিত নয়। কারণ এটি কোনো টেকসই সমাধান নয়। বিদ্যুৎ খাতের সমস্যা সমাধানে সরকারকে টেকসই সমাধানে দিকে আসতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশসহ অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম কম। বর্তমানে গড়ে গ্রাহকরা প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য প্রায় ৭ সেন্ট করে ব্যয় করছেন। অথচ গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ১১ সেন্ট। লোডশেডিংয়ের কারণে বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় রাখতে গিয়ে গ্রাহকের প্রায় ইউনিটপ্রতি ১১ সেন্টের মতোই ব্যয় হচ্ছে। তাই বিদ্যুতের ন্যূনতম দাম উৎপাদন ব্যয়ের সমান করতেই হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়া যেতে পারে।’
এর আগেও সরকারের এ ধরনের বন্ড ইস্যুর নজির রয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) দায়ের বিপরীতে একসময় ব্যাংকের অনুকূলে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হয়েছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের রাজস্ব আহরণ যদি কাঙ্ক্ষিত হারে না বাড়ে এবং পাশাপাশি ব্যাংক খাতের অনাদায়ী ঋণ পরিস্থিতি ও সরকারের ব্যয় দক্ষতার উন্নতি না হয়, তবে এ ধরনের পদক্ষেপ সরকারকে আরো সমস্যায় ফেলতে পারে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা, জ্বালানি খাতে ৬ হাজার ২৩২ কোটি, কৃষি খাতে ২৬ হাজার ৫৫ কোটি ও সারে ২৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ১ লাখ ১০ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।