পাবনা প্রতিনিধি : মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) এর উপস্থাপনকৃত ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দেখিয়েছিল পাবনার অনন্য সমাজ কল্যাণ সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান মাহফুজ আলী কাদেরীর বিরুদ্ধে।
এই সমস্যার নিরশন না করেই সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহফুজ আলী কাদেরী নির্বাহী পরিচালকের পদ দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সংস্থার সিনিয়র পরিচালক সেলিম আহমেদের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান যে, সংস্থার সাবেক চেয়্যারমান মাহফুজ আলী কাদেরী আবারো অনন্যর নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব নিচ্ছেন। সেই জন্য প্রতিষ্ঠানের সকল বিষয়ে তিনিই সকল সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, আমরা তার নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি তার মুখ থেকেই শুনেছি আর এ বিষয়টি আমাদের বর্তমান চেয়্যারমান সৈয়দ সাহারিয়া নিশ্চিত করেছেন। তার ভাষ্যমতে, বর্তমান নির্বাহী পরিচালক বরনা খাতুন আর দায়িত্বে থাকছেন না বলে শুনেছেন। তিনি আরো জানান যে , সাবেক চেয়্যারমান মাহফুজ আলী কাদেরীর কথা মতই এখন সকল কাজ পরিচালনা হচ্ছে। তার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তার নিজের আনুগত্য কর্মকর্তা ও কর্মীদের পাকাপোক্ত করছেন আর বর্তমানে যারা তার অবাধ্য কর্মকর্তা ও কর্মীদের ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি দিতে বাধ্য করছেন। ফলে সংস্থার ভেতরে দেখা দিয়েছে নানা অষন্তোষ, অনিয়ম, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি হযবরল অবস্থা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার কয়েকটি ব্র্যাঞ্চের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম, ফিল্ড অফিসার মো: সাগর সরদার, ফিল্ড অফিসার তানজিম ইসলাম সহ আরো অনেককে ব্যক্তিগত কারন দেখিয়ে অব্যাহতি লেটার উল্লেখ করে তাদেরকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য করছেন ।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মাহফুজ আলী কাদেরীর বিরুদ্ধে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) কয়েক বছর ধরেই অনন্য’র অর্থ আত্নসাতের বেশ কিছু অভিযোগ উত্থাপন করে যাচ্ছে। তাদের একটি চিঠিতে ৩৭টিরও বেশি অভিযোগ মাহফুজ আলী কাদেরীকে নিয়ে করা হয়েছে। সেখানে তিনি অনন্যর দায়িত্ব থাকাকালীন সময় থেকেই অনন্যর টাকা আত্নসাৎ, ব্যাংক থেকে এফডিআর নগদায়ন করা, স্টাফদের নামে বেতনের টাকা তোলা, প্রতিষ্ঠানের গাড়ী নিজে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা, প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজের ঘর ভাড়া দিয়ে প্রচুর টাকা তুলে নেওয়াসহ এমন বিভিন্ন অনিয়মের কথা উত্থাপিত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সাবেক এই শীর্ষ চেয়্যারমান এখন নতুন করে অনন্য নিয়ে আগাচ্ছে, তিনি থেমে নেই। অনন্য থেকে নতুন করে নতুন কৌশলে আবারো তিনি টাকা আত্মসাতের বিভিন্ন উপায় বের করছেন বলে অনন্যর কর্মকতা কর্মচারীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন অভিযোগ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিজেকে সেভ করতে সুকৌশলে ২০১৫ সালে মাহফুজ আলী কাদেরী নির্বাহী পরিচালকের পদ ছেড়ে চেয়ায়ম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নির্বাহী পরিচালক করা হয় লিয়াকত আলী নামের একজনকে। প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়ম, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে বিশৃংখল পরিস্থিতিতে লিয়াকত আলীকে অব্যহতি দিয়ে অনন্যর নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বরনা খাতুন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর নানা ঝুঁকি ও নিজের বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতা দিয়ে
হযবরল পরিস্থিতি কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হন। হঠাৎ আকস্মিক ভাবে বরনা খাতুনকে সরানোর বিষয়টি সংস্থার সকল কর্মচারীরা সাবেক চেয়্যামার মাহফুজ আলী কাদেরীর নতুন কোন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মনে করছেন এবং তিনি বর্তমান নির্বাহী পরিচালক বরনা খাতুনের অব্যহতির বিষয়টি নিজেই নিশ্চিত করছেন।
চলতি বছরেই সাবেক ওই নির্বাহী পরিচালকের নানা অনিয়ম, দূর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ অভিযোগগুলো চলমান থাকা অবস্থাতেই নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছেন মাহফুজ আলী কাদেরী। তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা সৎ, যোগ্য কর্মীদের ছাটাই করে আবার আখের গোছাতে এবং প্রতিষ্ঠানটির গতিশীল কার্যক্রম ঝিমিয়ে ফেলতে নিজের অনুসারী ও পছন্দের কর্মী নিয়োগ শুরু করেছেন এবং একই সাথে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অব্যহতি দিতে বাধ্য করার পাশাপাশি নির্বাহী পরিচালকের পদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। কর্মীদের দাবী দ্রুত এই নীলনকশা বন্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের জরুরী পদক্ষেপ জরুরী।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠান অনন্য সমাজ কল্যাণ সংস্থা ৮ হাজার সদস্যকে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে ফেরত পায়নি। এ কারণে এসব গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এসব গ্রাহকের কোনো অস্তিত্ব নেই। বেনামে নেওয়া ঋণের এই ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি সাবেক চেয়ারম্যান মাহফুজ আলী কাদেরীর বিরুদ্ধে। তিনি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের নামে ধার দেখিয়ে আরও ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া নিজের নামে, সাবেক স্ত্রীর নামে এবং কর্মীদের নামে অগ্রিম টাকা তোলাসহ সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানের ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন মাহফুজ আলী কাদেরী।
ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে থাকা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) তদন্তে এই অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটির পাবনার প্রধান কার্যালয়সহ ৯টি কার্যালয় পরিদর্শন করে মাহফুজ আলী কাদেরীর অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় এমআরএর প্রতিনিধিদল।
তবে এরপরও মাহফুজ আলী কাদেরীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অনন্য সমাজ কল্যাণ সংস্থা। এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। জানা যায়, গভর্নিং বড়ির সকল সদস্য মাহফুজ আলী কাদেরীর আত্নীয়স্বজন এবং সবাই তার অনুগত বলেই তিনি সুকৌশলে নিজেকে বাঁচাতে পারছেন।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি সুত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, অনন্য সমাজ কল্যাণ সংস্থার বিভিন্ন কার্যালয়ে পরিদর্শনের সময় নথিপত্র পর্যালোচনা করে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেই অনুযায়ী প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
এমআরএর তদন্তে উঠে এসেছে, অনন্য সমাজকল্যাণ সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান মাহফুজ আলী কাদেরী প্রতিষ্ঠানের এফডিআর করা প্রায় ৮ কোটি টাকা তুললেও প্রতিষ্ঠানে জমা দেননি। নিজের নামে, সাবেক স্ত্রীর নামে এবং কর্মীদের নামে প্রায় ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ৩০টির বেশি অনিয়ম, দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি গাড়ি মাহফুজ আলী কাদেরী নিজে ব্যবহার করতেন। কর্মকর্তারা এমআরএর প্রতিনিধিদের জানিয়েছিলেন, চাকরি রক্ষার্থে এ ধরনের কাজে তারা রাজি হয়েছিলেন। তবে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছিলেন তারা।
সে সময়ে সাবেক চেয়ারম্যান মাহফুজ আলী কাদেরী বলেন, ২০১৫ সালের পর তিনি আর এই প্রতিষ্ঠানের কোনো দায়িত্বে নেই। এমআরএ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছে। আর অনন্যর কোন বিষয়ে তিনি জানেন না এমনকি কোন সিদ্ধান্তে তিনি নেই।
সূত্র বলছে, অনন্য সমাজকল্যাণ সংস্থা গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে পাবনা অঞ্চলে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্যান্য ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের মতোই তারা ঋণ দিয়ে থাকেন।
জানা যায়, অনন্য সমাজ কল্যাণ সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান মাহফুজ আলী কাদেরী নিজের অনিয়ম থেকে মুক্ত রাখতে নিজের সকল পদপদবী থেকে সড়িয়ে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়াচাড়া করতেন। ছায়া হিসেবে লিয়াকত আলী নামে একজনকে নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ করে নানা অনিময়ে তাকেও বিতাড়িত করেন। এমনই ভাবে কয়েকটা নিবাহী পরিচালক নিয়োগ দিয়ে সবশেষে নিয়োগ বরনা খাতুনকে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে বর্তমান নির্বাহী পরিচালক বরনা খাতুনকে একাধিকবার মোবাইল কল করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায় ।প্রতিষ্ঠানের স্টাফরা জানান যে তিনি অসুস্থতার কারনে কিছুদিন ছুটিতে আছেন আর এই সুযোগ গ্রহন করে মাহফুজ আলী কাদেরী নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন নির্বাহী পরিচালকের পদ দখল করতে।
যোগাযোগ করা হয় অনন্য সমাজ কল্যান সংস্থার একাধিক কর্মকতার সাথে। তারা বলেন, সংস্থায় এখন হযবরল অবস্থা চলছে প্রতিষ্ঠানে কারন মাহফুজ আলি কাদেরী নতুন নতুন কাজের টার্গেট দিচ্ছেন , নিজে সবার সাথে ডেকে মিটিং করছেন , মাঠের সবাই ভিতিকর অবস্থায় রয়েছেন । ম্যাডাম থাকাকালে উদ্ভূত পরিস্থিতি কাটিয়ে তুলে সংস্থাকে গতিশীল করেছিলেন। আবার সংকটে পড়তে যাচ্ছে সংস্থা। তারা বলেন, মাহফুজ আলী কাদেরীর মতের বাইরে গেলে, মিডিয়াতে কথা বললে চাকরি হারাতে হবে। প্রতিটা দিন চলছে চাকরি হারানোর উৎকন্ঠায়। তবে প্রভাবশালী চক্রের কালো দৃষ্টি সড়াতে এবং এই সংকট নিরশনের দাবী করেছেন সংস্থার কর্মী।