সড়ক দুর্ঘটনায় খুব অল্প বয়সেই নিজের একটি পা হারান চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার হাড়োকান্দি গ্রামের রফিকুল ইসলাম। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে তার দরিদ্র পরিবার আরও দরিদ্র হয়ে যায়। দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকা রফিকুল যখন দিশেহারা তখন গ্রামেরই একজনের সহায়তায় কিস্তিতে কিনে ফেললেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা ইজিবাইক। এ ইজিবাইকের চাকা ঘোরার সঙ্গে রফিকুলের ভাগ্যের চাকাও ঘুরতে থাকে। আগের দায়-দেনা শোধ করে তার এখন দিনে আয় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
রফিকুল বলছিলেন, ‘একটা পা না থাকায় কাজকর্ম করতে পারতাম না। এখন ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চলে। তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। বিদ্যুৎ না থাকলে তো আমার এই আয় হতো না।’
দেশের শতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে যাওয়ায় গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নতির ফলে মানুষের জীবনমানে কতটা যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে, এটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এমন বহু উদাহরণ ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়ে।
অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তির একটি হলো বিদ্যুৎ। গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে পাঁচগুণেরও বেশি। দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার আমূল উন্নতি হয়েছে। তবে নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুতের অভাবে পুরোপুরি সুবিধা পাওয়ার পথে এখনো কিছু অন্তরায় রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে জ্বালানি ও ডলার সংকট অন্যতম একটি কারণ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর অবদান হয় ৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি ইউনিট। এর বাইরে আরও কিছু বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে ভারত থেকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে বিদ্যুতের খাতভিত্তিক অবদান প্রায় ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর এ অবদান বাড়ছে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বলেছিলেন, শহরের মতো গ্রামেও বিদ্যুৎ দিতে হবে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভেবেছিলেন, বিদ্যুৎ না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই ২০০৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেন তিনি। ২০২২ সালে দেশের প্রতিটি এলাকা বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এনেছে সরকার। এখন চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ দিতে কাজ করছে সরকার। বিদ্যুতায়নের প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ সুবিধা পেয়েছে বেশি। দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কারখানা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা সময় ভয়াবহ বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে উদ্যোক্তারা কারখানা করতে ভয় পেতেন, তবে এখন প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে। বিদ্যুতের প্রভাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ অনেক বেড়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। তখন ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে কলকারখানা থেকে শুরু করে জনজীবন, অর্থনীতি সবখানে ছিল স্থবিরতা আর অস্থিরতা। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের নানামুখী পরিকল্পনার ফলে দেশে এখন বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৫০৪ মেগাওয়াট। ১৪ বছর আগে মাত্র ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত। আর এখন পাচ্ছে শতভাগ মানুষ। বিদ্যুৎ সুবিধা থাকায় নতুন নতুন কারখানা তৈরি হয়েছে। বেড়েছে মানুষের কর্মসংস্থান। সেচে বিদ্যুৎ সংযোগের কারণে ফসল আবাদে সেচের খরচ কমেছে, বেড়েছে উৎপাদন। গ্রামে একসময় কেরোসিন জ্বালিয়ে পড়ালেখা ও অন্যান্য দৈনন্দিন কাজ চলত। বিদ্যুতের কারণে সেচ ও অন্যান্য খাতে কেরোসিনের ব্যবহার অনেক কমে যাওয়ায় কমেছে কার্বন দূষণ। বিদ্যুতায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে দ্রুত নগরায়ণ, এতে দেশ জুড়ে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল : এক দশক আগে গ্রামীণ অর্থনীতি ৭ লাখ কোটির হলেও এখন তা ২৫ লাখ কোটি ছাড়িয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের ফলে গ্রাম ও শহরাঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য কমেছে অনেক। সন্ধ্যা নামতেই নিñিদ্র অন্ধকারে নিস্তব্ধতা নেমে আসত দেশের অধিকাংশ গ্রামে। সেখানে এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেদ করে আলো ছড়িয়েছে, নিস্তব্ধতা ভেঙে তৈরি হয়েছে নানারকম কাজের পরিবেশ। বিদ্যুতের কারণে গ্রাম এমনকি প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের নতুন নতুন আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইজিবাইক বা অটোরিকশার মাধ্যমে আয় বেড়েছে, যাতায়াত সহজ হয়েছে। চার্জিং স্টেশন, চালকল, পোলট্রি খামার স্থাপনসহ নানাভাবে আয়ের পথ খুলে গেছে।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে ‘বাংলার টেসলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এ যানবাহন সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। সারা দেশে প্রায় ৪০ লাখ থ্রি-হুইলার রয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধার কারণে এর মাধ্যমে তাদের আয় হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতেও তাদের অবদান রয়েছে।
ইজিবাহক তুলনামূলক আরামদায়ক। তাছাড়া গভীর রাতে কিংবা যেকোনো সময় জরুরি প্রয়োজনে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ এ যানবাহনের মাধ্যমে তুলনামূলক কম ভাড়ায় শহরে কিংবা অন্য কোথাও যেতে পারছে।
বিদ্যুতের কারণে গ্রামাঞ্চলে হাটবাজার বেড়েছে। সেখানে রাতেও চলে বেচাকেনা। এতে মানুষের আয় যেমন বেড়েছে, তেমনি কেনাকাটাও অনেক সহজ হয়েছে। বিদ্যুতায়নের ফলে গ্রামাঞ্চলে এখন চুরি, ডাকাতির মতো অপরাধও আগের চেয়ে তুলনামূলক কমেছে। প্রসার হয়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের। গ্রামীণ নারীদেরও কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটা থাম্ব রুল আছে। তা হলো বিদ্যুতের প্রবৃদ্ধি যদি দেড় শতাংশ হয় তাহলে জিডিপিতে এর অবদান দাঁড়ায় ১ শতাংশ। দিনে দিনে আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, শিল্পকারখানা বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে। এগুলো কিন্তু বিদ্যুতের কারণেই হয়েছে।’
তিনি বলেন, শতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ফলে এখন গ্রামের মানুষেরও আয় বেড়েছে। ২০০৯ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৭৫ ডলার। এখন সেটি বেড়ে ৩ হাজার ডলারে পৌঁছেছে। বিদ্যুতের কারণে এই যে উন্নয়ন তা মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। গত ১৪ বছরে দেশের অর্থনীতির যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে তার মধ্যে অবকাঠামোর (যেমন সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি) উন্নয়নটুকু বাদ দিলে জিডিপিতে যে অগ্রগতি তার কৃতিত্ব বিদ্যুতের।
প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘একসময় বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকটে দেশের সব খাতই বিপর্যস্ত ছিল। সেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে। সরকারের প্রথম লক্ষ্য ছিল শতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানো। তাতে সফল হয়েছে। এখন নিরবচ্ছিন্ন মানসম্পন্ন বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা একে একে বাস্তবায়ন হচ্ছে।’
কৃষি ও পোলট্রি শিল্পে বিপ্লব : বিদ্যুতের কারণে কৃষিতে সেচ ব্যবস্থা এখন আরও সহজ ও সাশ্রয়ী হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার। এতে কৃষকের কায়িক শ্রমও কমেছে। সবমিলে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে সেচে বিদ্যুৎচালিত পাম্প ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার। সেটি এখন বেড়ে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ছাড়িয়েছে। গ্রিড বিদ্যুতের পাশাপাশি এখন সৌরবিদ্যুতের সাহায্যেও চলছে সেচ কার্যক্রম।
বিআইডিএসের সমীক্ষা বলছে, ২০১০ সালের আগে দেশে প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হতো চাল আমদানি বাবদ। সেচ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সংযোগ বৃদ্ধির ফলে এখন আর চাল আমদানি করা লাগে না।
ধান থেকে চাল তৈরির জন্য এখন প্রত্যন্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে চালকল। এতে কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি চাল তৈরির কাজটা সহজ হয়েছে। কমেছে এর ব্যয়ও। সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছে পশু ও মাছের খাবার তৈরির বহু কারখানা।
গত ১৪ বছরে দেশে খাদ্যশস্য ও পুষ্টি উপাদান যেমন মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ধান, ফল ও শাকসবজির উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। ২০০৯ সালে ছোট মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার টন, যা এখন আড়াই লাখ টনে পৌঁছেছে। বিদ্যুতের কারণে নানারকম আধুনিক উপায়ে মাছের চাষ বেড়েছে। আগে হ্যাচারির সংখ্যা ছিল ১০০টি, এখন হাজারেরও বেশি। পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ ১০-১২ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। খামারের সংখ্যা অন্তত ২০ লাখ। ডিম উৎপাদনে দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। গরুর মাংসেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশ এগিয়ে চলেছে।
শিক্ষায় অবদান : একসময় কেরোসিনের অভাবে দরিদ্র অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখায় বিঘœ হতো। এখন তাদের পড়ালেখার গতি বেড়েছে। বৈদ্যুতিক বাতি আর পাখার কারণে শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিল হয়েছে আলোকিত ও আরামদায়ক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমসহ নানান আধুনিক সুবিধা বেড়েছে বিদ্যুতের কল্যাণে।
২০০৫-০৬ সালের দিকে পাওয়ার সেল হিসাব করে দেখেছিল, বিদ্যুৎবিহীন একটি পরিবারে মাসে কেরোসিন দিয়ে কুপি বা হারিকেন জ¦ালাতে ৩০ টাকা ব্যয় হলে বিদ্যুৎ ব্যবহারে ব্যয় হতো মাত্র ৩ টাকা। ১০ গুণ ব্যয় কম করেও কেরোসিনের চেয়ে বেশি আলো দেয় বৈদ্যুতিক বাতি। এরপর আর এটা নিয়ে কোনো হিসাব করা না হলেও কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুতের ইতিবাচক প্রভাব এখন আরও বেশি।
টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির কলেজ অব বিজনেস জার্নালের জন্য করা ২০২১ সালের একটি বিশ্লেষণ বলছে, বিদ্যুতায়নের ফলে শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যায় পড়ালেখার সময় প্রতিদিন গড়ে ২১ মিনিট বাড়ায়। কর্মজীবী মানুষের সাপ্তাহিক কাজের সময় ২ দশমিক ২১ ঘণ্টা বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে কেরোসিনের ব্যবহার কমিয়ে কার্বন নির্গমন কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ফলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ৭ শতাংশ, আয় ৩০ শতাংশ এবং কর্মসংস্থান ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
চিকিৎসাসেবায় অগ্রগতি : বিদ্যুতের ফলে প্রত্যন্ত এলাকাতেও এখন চিকিৎসাসেবার মান বেড়েছে। পল্লী অঞ্চলে বসবাসরত অসহায় ও দুস্থদের চিকিৎসার জন্য প্রায় ২০ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোগেও গড়ে উঠেছে হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র। নতুন করে নির্মিত সরকারি-বেসরকারি কয়েক হাজার হাসপাতাল এসেছে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। ফলে এখন আর হুটহাট করেই চিকিৎসার জন্য শহরে যেতে হয় না।
তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবে বিদ্যুতের অবদান : গত এক যুগে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, যার মূলে রয়েছে বিদ্যুৎ। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে অঙ্গীকার পূরণ হয়েছে, তা বিদ্যুৎ ছাড়া সম্ভব ছিল না। এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যে কাজ চলছে সেখানেও দরকার নিরবচ্ছিন্ন মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ।
বিদ্যুতের কল্যাণে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে হাইটেক ও আইটি পার্ক, সফটওয়্যার পার্ক, ট্রেনিং সেন্টার, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারসহ তথ্যপ্রযুক্তির নানারকম প্রতিষ্ঠান। দেশে ইন্টারনেট সংযোগ সংখ্যা সাড়ে ১২ কোটি ছাড়িয়েছে। বেড়েছে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা। এর ফলে বহুমুখী সুবিধার দ্বার খুলেছে। কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধির ফলে অনলাইনে নানারকম আয়ের সুযোগ বৃদ্ধিসহ অনেক কাজ এখন গ্রামেই হচ্ছে। এজন্য আর শহরে ছুটতে হয় না। এখন নিবন্ধিত দুই হাজারের বেশি আইসিটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এক লাখেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এ খাতে।
ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবহার ও উৎপাদন বেড়েছে : শতভাগ বিদ্যুতায়নে দেশ জুড়ে বিপুল অবকাঠামো, শিল্পায়নসহ নানারকম উন্নয়নের ফলে স্থানীয় বৈদ্যুতিক কেবল প্রস্তুত শিল্পের আকার ২ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বৈদ্যুতিক বাতি, পাখাসহ নানারকম যন্ত্রাংশের ব্যবহার ও বিক্রি বেড়েছে। এসব পণ্য বিক্রির জন্য সারা দেশে অন্তত ৭০ হাজার খুচরা দোকান গড়ে উঠেছে। অন্তত তিন হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাও এতে অংশ নিয়েছেন।
এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের। এদের একটি বড় অংশই গ্রাম থেকে আসা মানুষ। তাদের আয়ের একটি অংশ গ্রামে যাচ্ছে। ফলে সেখানকার অর্থনীতিতেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। নতুন নতুন দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। নানারকম ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। মোবাইল ফোন, টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার, মাইক্রোওভেনসহ বিভিন্ন পণ্য এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। বিদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি হয় তুলনামূলক আগের চেয়ে অনেক কম। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি আবার এসব পণ্যের দামও কমেছে অনেক। এসব পণ্যের ব্যবহারে শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্রও পাল্টে গেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নামকরা ব্র্যান্ডের পণ্য এখন বাংলাদেশেই তৈরি করছে। আবার দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানও ভালো।
বৈদ্যুতিক যানবাহনের যুগে বাংলাদেশ : পরিবেশবান্ধব ও ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ায় বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতিমধ্যে দেশে পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ি চালু হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালাও করেছে। এসব যানবাহন চার্জিংয়ের জন্য এরই মধ্যে একাধিক চার্জিং স্টেশনও নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশেও ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ গাড়ি বিদ্যুতে চলাচল করবে, এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডি ঢাকায় তাদের বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেছে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের জন্য চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে কারখানা স্থাপন করা হয়েছে।