বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাট ও রেস্টুরেন্টগুলো চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নগর উন্নয়ন কমিটি। রাজউকের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বা ব্যবহার সনদ ছাড়া কোনো ভবনে ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া যাবে না এবং গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি। গতকাল সোমবার সকালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সভাকক্ষে গণপূর্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁগুলোতে রবিবার রাতে শুরু হয়েছে অভিযান। এরই অংশ হিসেবে গতকাল ধানম-ির ১২টি রেস্তোরাঁ সিলগালা করা হয়েছে। এ ছাড়া পুরান ঢাকায় কয়েকটি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে ১৭ জনকে আটক করা হয়েছে। অন্যদিকে বেইলি রোডে অগ্নিকা-ের ঘটনায় একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নোটিস দৃশ্যমান স্থানে টানানোর নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো ভবন নির্মাণ করা হলে সেটি ব্যবহার বা বসবাসের আগে ব্যবহার সনদ বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক। এই সনদ না নিয়ে ভবন ব্যবহার করা যাবে না। একটি ভবন সঠিকভাবে তৈরি হয়েছে কি না, ভবনটি ব্যবহারের জন্য নিরাপদ কি না, সেটি নিশ্চিত করার জন্যই অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বা ব্যবহার সনদ। এটি পেতে ভবনটি কি আবাসিক নাকি কমার্শিয়াল হবে সেটি জানিয়ে ভূমি ব্যবহারের যে অনুমোদন নেওয়া হয় তার ভিত্তিতে যে নকশা অনুমোদন হয়েছে ভবনটি ঠিক সে রকম তৈরি হয়েছে কি না, সেটি নিশ্চিত করতে হয়।
অর্থাৎ কেউ যখন কোনো ভবন নির্মাণ করবেন তা নির্ধারিত নকশা অনুযায়ী সিঁড়ি, ফায়ার ফাইটিং, ফায়ার এক্সিট, ব্যবহারের ধরন আছে কি না, সেটি দেখার পরই অকুপেন্সি সার্টিফিকেট পাওয়ার কথা।
অনুমোদনহীন ও নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা ভবনের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে রাজউক। কিন্তু যেসব ভবন আবাসিক বা অফিসের অনুমোদন নিয়ে হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালাচ্ছে সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডে অগ্নিকা-ে ৪৬ জনের প্রাণহানির পর সংস্থাটি নড়েচড়ে বসেছে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা, রাজউকের আওতাধীন এলাকার আবাসিক কাম অফিস হিসেবে নির্মিত কোনো ভবনে দোকানপাট ও রেস্টুরেন্ট পরিচালনার সুযোগ দিতে চান না। এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে গতকাল নগর উন্নয়ন কমিটির বৈঠকে বিষয়টি উপস্থাপন করে রাজউক। বৈঠকে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে রাজউকের আওতাধীন এলাকায় অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ছাড়া কোনো ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সামনে বড় আকারে নোটিস টানানো থাকবে। গুগল ম্যাপে ট্যাগ করে দেওয়া হবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নোটিস। ভবন ও কমার্শিয়াল ভবনের ক্ষেত্রে বীমা করতে হবে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে যথাযথ ডকুমেন্ট নিশ্চিত করা হবে। অনুমোহীন ভবনের অবস্থা যাচাইয়ে থার্ড পার্টি নিয়োগের বিষয়ে যে নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছে, তা চূড়ান্তকরণে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে মতামত প্রদান করা।
গণপূর্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, রাজউকের অধীন যেসব ভবনে দোকানপাট-রেস্টুরেন্ট চলেছে সেগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হবে। অভিযানকালে কোনো ভবনের সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বা অন্য কোনো মালপত্র পাওয়া গেলে সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে। এ ছাড়া যেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে, সেগুলোর চিহ্নিতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রাজউকের তথ্য বলছে, রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের আওতাধীন এলাকায় ২১ লাখ ৪৫ হাজার ৭৪৬টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ৯৯ হাজার ভবনের অনুমোদন আছে। আর ২০ লাখ ৪৬ হাজার ১৮৩টি ভবনের অনুমোদন নেই। হিসাব বলছে, ৯৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ ভবনই অনুমোদনহীন। এ ছাড়া অনেক আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর এলাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক ও রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, রাজউকের অধীন যেসব অনুমোদনহীন ভবন রয়েছে তা চিহ্নিত করতে থার্ড পার্টি নিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে রাজউকের। পরে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রস্তুতের জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। কমিটি তাদের নীতিমালা নগর কমিটিতে উপস্থাপন করে। সেখানে এ নীতিমালা চূড়ান্ত করতে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে মতামত দিতে বলা হয়। এ ছাড়া আরও কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রেস্তোরাঁয় অভিযান, ৫২ জন আটক : ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁগুলোতে রবিবার রাতে শুরু হয়েছে অভিযান। বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশত রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে ৫২ জনকে আটক করা হয়েছে। সিলগালা করা হয়েছে এক ডজনেরও বেশি রেস্তোরাঁ। ঢাকা মহানগর পুলিশ, সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এসব অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
গতকাল ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডের সব বুফে রেস্তোরাঁ সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারপরই ছিল ওয়ারীর র্যাংকিং স্ট্রিটের ২০টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালানো। শুধু এ রোড থেকেই আটক করা হয়েছে ১৭ জনকে।
জানা গেছে, প্রথমে রবিবার সন্ধ্যায় অভিযান শুরু হয় এয়াররপোর্ট উত্তরা ও ধানমন্ডি থানা এলাকায়। উত্তরা জোনে ধরা হয় ১৭ জনকে। ধানমন্ডি এলাকায় অন্তত ২২টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন ধানমন্ডি থানার ওসি পারভেজ ইসলাম। এ ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে।
এদিন দুপুরে গাউছিয়া টুইন পিক ভবনে অভিযান চালিয়েছে রাজউক। অভিযান চলাকালে ভবনের ছাদে থাকা রুফটপ রেস্তোরাঁ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভবনের সবকটি রেস্তোরাঁ সিলগালা করেছেন রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানজিনা সারোয়ার। এ ভবনে বুফে রেস্তোরাঁ আছে সাতটি। ভবনটির বাণিজ্যিক এফ-১ ক্যাটাগরির অনুমোদন থাকলেও রেস্তোরাঁর জন্য এফ-২ ক্যাটাগরির অনুমোদন প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন রাজউকের কর্মকর্তারা। সেটি না থাকায় রেস্তোরাঁগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।
সাত মসজিদ রোডের জিএইচ হাইটস ভবনেও অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। সেখানকার একজন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, কয়েকজনকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এখানে তেমন কোনো অনিয়ম খুঁজে পায়নি পুলিশ।
এদিকে পুলিশ জানায়, রাজউকের অভিযানের পর ধানমন্ডির টুইন পিক টাওয়ারে অনুমোদনহীন ও নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা ১২টি রেস্তোরাঁ সিলগালা করা হয়েছে। একই সঙ্গে জরিমানা করা হয়েছে একটি রেস্তোরাঁকে।
অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নোটিস দৃশ্যমান স্থানে টানানোর নির্দেশ হাইকোর্টের : অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নোটিস দৃশ্যমান স্থানে টানানোর নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পৃথক রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে গতকাল বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশসহ রুল জারি করে।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১০টার দিকে বেইলি রোডের একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় বেইলি রোডসহ ঢাকা সিটিতে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা, হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা এবং তদন্তে বিচারিক কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে গত রবিবার রিট করেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। আইনজীবী ইশরাত জাহানও একটি রিট করেন।
দুই আইনজীবীর রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে সোমবার দুপুরে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে আইন অনুসারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না এবং ভবিষ্যতে আরও কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দিয়েছে হাইকোর্ট। এ কমিটিকে চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে দৃশ্যমান স্থানে নোটিস টানাতেও বলা হয়েছে।