লোকসানে ডুবে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) বিপর্যয় সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন সংস্থাটির কর্মীরা। অনিয়মও তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে পরিবর্তনের সুফল সড়কে পাওয়া যাচ্ছে।
যাত্রীসেবার মান তুলনামূলক ভালোর দিকে যাচ্ছে। ডিপো থেকে দূর হয়েছে অচল বাস। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাসের সঙ্গে মহানগর ও দূরপাল্লায় সমানতালে প্রতিযোগিতা করছে বিআরটিসি।
বিআরটিসির অথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে মাসে সাড়ে ছয় কোটি টাকা বেতন দিতে পারত না প্রতিষ্ঠানটি। এখন মাসে সাড়ে ১০ কোটি টাকা বেতন নিয়মিত পরিশোধ করছে। ১০১ কোটি টাকার বকেয়া বেতন-ভাতার মধ্যে ৭৭ কোটি টাকা করপোরেশনের নিজস্ব আয় থেকে পরিশোধ করা সম্ভব হয়েছে। বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম বলেন, তিন বছর আগে ১১১টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেগুলো সমাধানে কাজ চলছে। এখনো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। এই প্রতিষ্ঠান একেবারে অনিয়ম-দুর্নীতিতে ঘেরা ছিল। সেই তলানি থেকে উন্নত জায়গায় তুলতে আরো সময় লাগবে।
পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বিআরটিসি যেভাবে সরকারের উদারতা পায়, সে অনুপাতে কাজ করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে শুধু দায়হীন কমিটমেন্ট দিয়ে যাচ্ছে। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে পেশাদারিতে রূপান্তর করতে পারলে প্রতিষ্ঠানটি নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে।
সড়কে আনুপাতিক হারে বাস বেড়েছে
সারা দেশে ২২টি বাস ডিপো ও দুটি ট্রাক ডিপোর অধীনে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে সরকারি এই সংস্থা। ২০১৮ সালে বিআরটিসির বহরে মোট এক হাজার ৪৩৫টি বাস ছিল। তখন নিয়মিত চলাচল করার উপযোগী বাস ছিল ৯৩৭টি। পরের বছর এক হাজার ৮৫৪টি বাসের মধ্যে সড়কে চলত এক হাজার ২৯টি বাস। ২০২০ সালে এক হাজার ৮২৫ বাসের মধ্যে ৮২৫টি বাস চলাচল করতে পারত।
পরের বছরগুলো থেকে এই চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। বহর থেকে বাতিল বাস বাদ দেওয়া শুরু হয়। এতে ডিপোগুলোতে সচল বাস রাখার জায়গা তৈরি হয়। ২০২১ সালে এক হাজার ৭৬২টি বাসের মধ্যে এক হাজার ১০৬টি বাস সড়কে চলেছে। পরের বছর এক হাজার ৩৫০টি বাসের মধ্যে এক হাজার ২৩৩টি এবং ২০২৩ সালে বহরে থাকা এক হাজার ৩৫০টি বাসের মধ্যে এক হাজার ২৫৩টি বাস সড়কে চলাচল করেছে।
বেসরকারি বাসের সঙ্গে একধরনের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছে বিআরটিসি। এতে যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাস নেই, সেখানে বিআরটিসির মাধ্যমে যাত্রীরা সেবা পাচ্ছেন। শুধু সেবা দিতে গিয়ে কিছু জায়গায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। যেমন নগর পরিবহন। বাস রুট রেশনালাইজেশনে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেসরকারি বাস ব্যাপকভাবে যুক্ত না হলেও চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে বিআরটিসি।
এ ছাড়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে বিআরটিসির বহর থেকে প্রথম বাস চলাচল শুরু হয়। বর্তমানে রাজধানীর ফার্মগেট, কুড়িল বিশ্বরোড, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী থেকে সরাসরি বিআরটিসির বাস চলাচল করছে। স্মার্ট বাসও পরিচালনা করছে এই প্রতিষ্ঠান। এতে স্কুলগামী শিশুরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পাচ্ছে।
আয় বেড়ে মুনাফা
২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিআরটিসির আয় ছিল ২৫৩ কোটি ১৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় হয় ২৫৮ কোটি ৫২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। পরের বছর প্রায় ২৫৯ কোটি টাকা আয় হলেও ব্যয় হয়েছে ২৬৬ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩১৬ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩১৯ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরে বিআরটিসির আয়-ব্যয় ছিল প্রায় সমান সমান। সামান্য কিছু আর্থিক লাভের মুখ দেখে করপোরেশন। ওই বছর প্রায় ৩৪৬ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ৩৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়। পরের বছর প্রায় ৪৭৬ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় ৪৪০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৬৩২ কোটি টাকা আয় হয়। ব্যয় ৫৮৪ কোটি টাকা।
বিআরটিসির গত ১০ বছরের অর্থ ও হিসাব বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি টানা লোকসান গুনেছে। তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে করপোরেশনের লাভ বাড়ছে। একই সঙ্গে বেড়েছে কল্যাণ তহবিলে বরাদ্দ।
বেড়েছে কারিগরি দক্ষতা, কমেছে অনিয়ম
দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল গাজীপুরের কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানা। ২০২১ সালের ২৬ জুন কারখানাটি সচল করা হয়। এখন পর্যন্ত এই কারখানায় ৮৫টি অচল বাস মেরামত করা হয়েছে। বাসগুলো এখন সড়কে চলছে।
এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় কারখানাসহ তেজগাঁওয়ে গ্লাস তৈরির প্লান্ট বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গাড়ি পরিষ্কারের জন্য ওয়াশ প্লান্ট বসানো হচ্ছে। ১৯৯২ সালে তেজগাঁওয়ের কারখানায় বাস ট্রাকের ভারী মেরামত কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ২০২৩ সালে এসে এই কারখানায় ভারী মেরামত কার্যক্রম আবার চালু হয়।
কর্মীদের নিয়মিত বেতন দেওয়ার পাশাপাশি সব ধরনের ভাতা নিয়মিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বোনাস বেড়েছে। কর্মীদের আয় বাড়ায় আগের চেয়ে অনিয়ম কমে এসেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এখন বেতন ঠিকমতো হচ্ছে। কেউ অবসরে গেলে এক মাসের মধ্যে তাঁদের ফাইল প্রসেস শুরু হয়। বোনাস বাড়িয়ে দিচ্ছি। আপনি যখন বৈধভাবে তাঁদের আয় ঠিক রাখবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই অনিয়ম কমবে।’