বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : আবারও দেশীয় খনি থেকে কয়লা উত্তোলনে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রস্তুত হয়েছে একটি পরিকল্পনা। যেটিতে বড়পুকুরিয়াসহ অন্য ৪টি খনির সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে। পরিবেশের ক্ষতি না করে কীভাবে কয়লা উত্তোলন করা যায়, এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা তৈরি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের জন্য। যেখানে রয়েছে কীভাবে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা করা হবে, স্থানীয়দের পুনর্বাসন, উত্তোলন শেষে ভূমিকে আবার চাষযোগ্য করে তোলাসহ সার্বিক বিষয়।
যদি প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায় তা হলে এটি নিয়ে কাজ শুরু হবে। উত্তরোত্তর শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। শিল্প-কারখানা, বাসা-বাড়ি, স্কুল-কলেজ সর্বত্র প্রয়োজন হচ্ছে বিদ্যুতের। গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার থেকে ১৮ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। যদিও চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি কিন্তু, তার পরও রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতা।
আর এই প্রতিবন্ধকতার অন্যতম কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানির অপ্রতুলতা। শিল্পায়নের ফলে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। আন্তর্জাতিক বাজারেও এলএনজির মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না প্রায় সময়ই। এক্ষেত্রে বিকল্প উৎস কয়লা। নির্মাণাধীন ও চালু মিলিয়ে কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় দাঁড়াচ্ছে ১১ হাজার ৩২৯ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে বছরে মোট কয়লার প্রয়োজন হবে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন টন। যার বেশিরভাগই করতে হবে আমদানি।
তবে ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে আবারও দেশীয় খনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলনের তোড়জোড় শুরু করেছে সরকার। প্রায় সব খনিতেই চলছে সম্ভাব্যতা যাচাই। পানি ব্যবস্থাপনা ও জমির মালিকদের পুনর্বাসন সাপেক্ষে অন্তত ৪টি খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য প্রাথমিক প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। যদি ফুলবাড়ীর মতো কোনো জন অসন্তোষ তৈরি না হয় তা হলে দেশের জ্বালানি খাতে আবারও একটা বৈপ্লবিক সূচনা হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে দেশে মোট কয়লা ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে ৫টি। যেগুলোতে মোট কয়লার মজুতের পরিমাণ ৭ হাজার ৮২৩ মিলিয়ন টন (যা ২০০.৩ টিসিএফ প্রাকৃতিক গ্যাসের সমতুল্য) এর মধ্যে বড়পুকুরিয়ায় মজুত রয়েছে ৪১০ মিলিয়ন টন কয়লা, দীঘিপাড়ায় রয়েছে ৭০৬ মিলিয়ন টন, ফুলবাড়ীতে ৫৭২ মিলিয়ন টন, খালাসপীরে ৬৮৫ মিলিয়ন টন আর জামালগঞ্জে রয়েছে ৫ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন কয়লার মজুত।
অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি বিএইচপি মিনারেলস ১৯৯৭ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লাখনি আবিষ্কার করে। যেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে চেয়েছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জি। কিন্তু ২০০৬ সালে তীব্র জন আন্দোলনের মুখে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সরকার। বর্তমান সরকার তখন বিরোধী দলে। তাদের পক্ষ থেকে গড়ে তোলা হয়েছিল তীব্র আন্দোলন। যার ফলে খনিটি থেকে কয়লা উত্তোলনের কাজ আর এগোয়নি।
তবে যেহেতু এই খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা সম্ভব। তাই প্রায় ১৮ বছর পর আবারও এটিতে কয়লা উত্তোলন করা যায় কি না তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, এই খনির লাইসেন্স এখন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান জিসিএমের হাতে। জিসিএমের অধিকাংশ শেয়ার একটি চীনা কোম্পানির।
জিএসএম এই খনি উন্নয়নে একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকেও যাচাই-বাছাই চলছে। তবে এখনই চূড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। এখানে পানি ব্যবস্থাপনা রয়েছে। জমির মালিকদের পুনর্বাসনের বিষয়টি রয়েছে। চাইলেই তো আর খনি থেকে কয়লা উত্তোলন সম্ভব নয়। দেখা যাক কি হয়!
বর্তমানে দেশে একমাত্র কয়লা উত্তোলন হয় দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া থেকে। ২০০৫ সালে এটি থেকে কয়লা তোলা শুরু হয়। এ খনিতে মজুত আছে প্রায় ৪১০ মিলিয়ন টন কয়লা। বর্তমানে মধ্যভাগ থেকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে ২ কোটি টন কয়লা তোলা যাবে। বড়পুকুরিয়া থেকে এখন বছরে ৮-১০ লাখ টন কয়লা তোলা হচ্ছে, যা দিয়ে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে। উত্তর অংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে সমীক্ষা প্রক্রিয়াধীন।
এর বাইরেও রয়েছে আরও আবিষ্কৃত খনিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ খনিটি। এর গভীরতা ৬৪১ মিটার থেকে ১১৫৮ মিটার। এখানে মজুত রয়েছে ৫ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন কয়লা। এত পরিমাণ কয়লা মজুত থাকলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখান থেকে কয়লা উত্তোলন প্রায় অসম্ভব উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, এটির গভীরতা এত বেশি যে এটি থেকে উন্মুক্ত আকারেই কয়লা তুলতে হবে।
কিন্তু এর জন্য যে পরিমাণ জমির প্রয়োজন পড়বে তার সংকুলান করাই মুশকিল। ধরে নিলাম স্থানও সংকুলান হয়ে গেল কিন্তু পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এটি থেকে কয়লা উত্তোলন করার চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে অন্য খনিগুলো নিয়ে কাজ করা উচিত হবে। এক্ষেত্রে দিনাজপুরের দীঘিপাড়া খনিটি নিয়ে কাজ করা যায়। এর গভীর ৩২৮ মিটার থেকে ৪৫৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। যদিও এখানে মজুত কম। মাত্র ৭০৬ মিলিয়ন টন। তবে উন্মুক্ত পদ্ধতি ছাড়াই এটি থেকে উত্তোলন সম্ভব হবে।
তবে ফুলবাড়ীয়া, দীঘিপাড়া, জামালগঞ্জ ছাড়াও রংপুরের খালাসপীর খনিরও সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের জ্বালানির চাহিদা বেড়েই চলছে। এখন আমরা আমদানি করে চাহিদা মিটাচ্ছি। কিন্তু একটা সময় আসবে আমাদের স্বনির্ভর হতেই হবে। গ্যাসের চাহিদা মেটাতে আমরা দেশীয় কূপগুলো নতুন করে খননের কাজ শুরু করেছি। আমাদের সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রও হয়ে গেছে।
দেশে যেহেতু সব মিলিয়ে ৫টি কয়লা খনি রয়েছে। তাই সেগুলো থেকে উত্তোলন করা যায় কি না আমরা তা ভাবছি। তিনি বলেন, সম্প্রতি হাইড্রোকার্বন ইউনিটের পক্ষ থেকে দেশীয় কয়লার ওপর একটি প্রস্তাবনা আমরা পেয়েছি। এতে বলা হয়েছে, দেশে জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে। গ্যাসের মজুত কমছে। ফলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর চাপ বাড়বে। কেন্দ্রগুলোর চাহিদা অনুসারে কয়লা আমদানি করতে হলে আগামীতে বছরে ৬ বিলিয়ন ডলার লাগবে। কিন্তু আপনারা জানেন ডলার সংকট আমাদের জন্য এখন অন্যতম বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক্ষেত্রে দেশীয় কয়লার নিশ্চিয়তা পেলে ডলারের ওপর চাপ কমবে, জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। তিনি বলেন, কয়লা তোলা হবে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেই। স্থানীয়দের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে। ওইসব অঞ্চলে কয়লার খনি হলে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন কমবে। বিপরীতে আগামীতে বছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার কয়লা আমদানি করতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের জন্য। তার অনুমতি পেলেই আমরা কিভাবে কাজ শুরু করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করব।
তবে কয়লা উত্তোলনে বিরোধিতাকারী পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা বলছেন, খনির কারণে এলাকার কৃষি জমি ধ্বংস, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা নষ্ট ও পরিবেশ দূষিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময় বলেছেন, কৃষি জমির ক্ষতি করে কয়লা তোলা হবে না। এ জন্য জ্বালানি বিভাগ বিশদ জরিপ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি প্রস্তাবনা নিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা করা হবে, স্থানীয়দের পুনর্বাসন, উত্তোলন শেষে ভূমিকে আবার চাষযোগ্য করে তোলাসহ সার্বিক বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
তেল-গ্যাস, খনিজসম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এর ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। পরিবেশের ক্ষতি তো হচ্ছেই, অর্থনীতিও চাপে পড়েছে। নতুন করে কয়লা তোলার উদ্যোগ নেওয়া হলে তা হবে আরও সর্বনাশা সিদ্ধান্ত। ফুলবাড়ীর আন্দোলনের সময় স্থানীয়রা নিজেদের রক্ষায় জীবন দিয়েছিল। তাই সরকার আবার এই হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে না বলে আমরা আশা করছি।
তবে হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মতে, খনির জন্য ফুলবাড়ীতে একবারে ভূমি লাগবে ২ হাজার হেক্টর। কয়লা তোলার পর আবার ৩-৫ বছরের মধ্যে সেই জমি কৃষি কাজের উপযোগী করা হবে। সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, কয়লা তোলার পর খনি এলাকায় পুনর্বাসন করা জমির রূপ হবে কৃষি ২ হাজার ৫৫০ হেক্টর, বনভূমি ১ হাজার ৯৪৬ হেক্টর আর জলাভূমি ৬৯৬ হেক্টর। প্রচিলত কৃষি থেকে পাওয়া ফসলের দরের চেয়ে উত্তোলিত কয়লাসহ অন্য খনিজে লাভ হবে ২০ গুণ।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি প্রকল্প বাতিল, জাতীয় সম্পদ রক্ষা এবং বিদেশী কোম্পানি এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে সকাল থেকেই ফুলবাড়ীর ঢাকা মোড়ে ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ ও পার্বতীপুর উপজেলার হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হতে থাকে। দুপুর ২টার দিকে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ও ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটির নেতৃত্বে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল নিমতলা মোড়ের দিকে এগোতে থাকলে প্রথমে পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের বাধায় বিশাল মিছিলটি জঙ্গিরূপ ধারণ করে।
মিছিলটি পুলিশ-বিডিআরের ব্যারিকেড ভেঙে এগুতে থাকলে আন্দোলনকারীদের ওপর টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও গুলিবর্ষণ করা হয়। বিডিআরের গুলিতে এ সময় নিহত হয় আল আমিন, সালেকীন ও তরিকুল। আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ। আহতদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এরপর পুলবাড়ীবাসী ধর্মঘটের মাধ্যমে এলাকায় অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। বাধ্য হয়ে তৎকালীন সরকার ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে এশিয়া এনার্জিকে দেশ থেকে বহিষ্কার, দেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে নাসহ ছয় দফা চুক্তি করে।
এরপর এলাকাবাসী ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন। এই ঘটনার ১৮ বছর পর আবারও উন্মুক্ত বা সুড়ঙ্গ যে পথেই হোক কয়লা উত্তোলন করার সিদ্ধান্ত নিতে হলে সরকারকে পরিবেশ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।