শাহনাজ বেগম (মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি) : মুন্সীগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরোধিতাকারী অভিযুক্ত শিক্ষক এখনো বহাল তবিয়তে। ফলে ছাত্র-জনতা,অভিভাবক ও অধিকাংশ শিক্ষকরা ফুসে উঠছেন। সম্প্রতি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতি, আওয়ামী দলীয় দাপটসহ ক্ষমতার ব্যবহার থেমে নেই।
৫ আগস্ট বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হওয়ার পর এ ব্যাপারে এলাকার সচেতন মহল, সহকারী শিক্ষক মনোরঞ্জন সূত্রধরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সহ অন্যত্র বদলির দাবি করে আসছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরের আলবার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্র মোহন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মনোরঞ্জন সূত্র ধর দীর্ঘ বছর ধরে একই বিদ্যালয়ে চাকরি চাকরি করে আসছেন, ফলে তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠায় ছাত্র-জনতা সহ স্বয়ং অভিভাবকরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ,
সহকারি মনোরঞ্জন শিক্ষক তার কাছে কোচিং না করা শিক্ষার্থীদের নাম্বার কম দেয়া, কোচিং ব্যবসা, অনৈতিক আচরণের একাধিক অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া বিগত ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী কাজী কমর উদ্দিন সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষার্থীর সাথে পরীক্ষার হলে অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয় মনোরঞ্জন ধরসহ আরো দু’জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বাধা প্রদান এবং ইতিপূর্বে তার বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসকের বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করে।
পরবর্তীতে অভিযুক্ত শিক্ষক মনোরঞ্জন তার পক্ষে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামতে প্ররোচিত করেন বলে জানায়। তার পক্ষে জেলা প্রশাসকের বরাবরের স্মারকলিপি প্রদানকারী কতিপয় শিক্ষার্থী।
এই সকল অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমান শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক সহ সকলে তাকে বরখাস্তের আহ্বান জানান। এ সময় অভিযুক্ত শিক্ষক মনোরঞ্জন সূত্রধর সকলের উপস্থিতিতে আবেদনে স্বাক্ষর করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জেলা প্রশাসন কর্তৃক নিযুক্ত তদন্তকারী দল মনোরঞ্জন কে বিদ্যালয় ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে কর্মরত ৩৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩০ জনই তার গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে তার অপেশাদার আচরণ ও তার দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে তাদের স্বাক্ষরিত অভিযোগপত্রটি জমা দেন।
একই সাথে ৫ সেপ্টেম্বর বদলির আবেদনকৃত মনোরঞ্জন ধরের আবেদন পত্রটি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় আছে বলেন, স্কুলটি প্রধান শিক্ষক নূরে আলম। তিনি আরো জানান, ৪-৫ বছর ধরেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রায় সময়ই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা যায়। বিগত পাঁচ মাস যাবত আমি এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর তার সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ্য করে শিক্ষার্থীরা সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবর একটি অভিযোগ পত্র দাখিল করে। তার একটি অনুলিপি আমাকে দেওয়া হয়েছে। তার স্বাক্ষরিত বদলির আবেদনটি জেলা প্রশাসন হয়ে এখন বোর্ডে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। স্কুলের বিশৃঙ্খলা এড়াতে পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত তিনি ছুটিতে আছেন বলেও জানান প্রধান শিক্ষক।
এত কিছুর পরেও থেমে নেই শিক্ষক মনোরঞ্জনধর।
সম্প্রতি একটি অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের মনগড়া অসত্য তথ্য প্রকাশ করেছেন মনোরঞ্জন ধর যা আমাদের সুনাম নষ্ট করছে বলে অভিযোগ করেন একই স্কুলের শিক্ষক আরিফ, রাসেল, গফুর, মাহফুজ সহ আরো অনেকে। একই সাথে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন বলেও জানান এই শিক্ষকরা।
এ ব্যাপারে শিক্ষক মো. আব্দুল গফুর সরকার বলেন, প্রায় ৭ বছর যাবৎ অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সাথে শিক্ষকতা করে আসছি। বিদ্যালয়টি ২ শিফটের এবং আমি প্রভাতি শাখায় ও মনোরঞ্জন স্যার দিবা শাখায়। ভিন্ন বিষয়ের হওয়ায় বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন ও বিদ্যালয়ের মিটিং ছাড়া আমাদের দেখা হওয়ার কোন সুযোগ নেই। উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত বা পেশাগত কোন বিরোধও নেই। বিদ্যালয়ের ৩০ জন শিক্ষক উনার বিরুদ্ধে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে অভিযোগ করায় তিনি অনুমান ও সন্দেহের বসত আমার নামে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তবে আমার ব্যাপারে ওনার সকল বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
আরেক শিক্ষক মাহফুজুর রহমান বলেন, ২০২২ সালে এই বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই বর্তমান ও প্রাক্তন বিভিন্ন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের কাছে থেকে ওনার বিতর্কিত কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত হই। ০৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ে তার বিরুদ্ধে শুনানি গ্রহণকালে আমি নিজে ও কয়েকজন শিক্ষক মিলে তাকে সুরক্ষা দিয়ে বিভিন্ন রুমে যাতায়াত করতে সহায়তা করি। ঐদিন বিদ্যালয়ের প্রায় শতাধিক প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মনোরঞ্জনের বিপক্ষে অভিযোগ দিতে আসে যাদের অধিকাংশই আমাদের যোগদানের পূর্বের শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। ওনার বিপক্ষে অভিযোগগুলোকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য শিক্ষকদের দলাদলির বিষয়কে তুলে ধরছেন যা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
আরিফ হোসেন নামের অপর একজন শিক্ষক জানান, আমার সাথে মনোরঞ্জন স্যারের ব্যাক্তিগত কোন দ্বন্দ্ব নেই। শত শত শিক্ষার্থী ও অভিভাবক দ্বারা অভিযুক্ত হওয়ার পর কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই কেন আমাকে এই বিষয়ের সাথে জড়ালেন তা আমার বোধগম্য নয়। অথচ তার বিরুদ্ধে ডিসি অফিস ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিদ্যালয়ের ৩৪ জন শিক্ষকের মধ্যে হিন্দু শিক্ষক সহ ৩০ জন শিক্ষক ২১ পৃষ্ঠার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এখানে কেউ ব্যাক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে নি বরং সামষ্টিকভাবে । তাই, ৩০ জন শিক্ষকের নাম উল্লেখ না করে অল্প কয়েকজন শিক্ষকের নাম জড়ানো স্পষ্টত উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নবম ও দশম শ্রেণীর কয়েকজন অভিভাবক জানান, বিদ্যালয়ে মনোরঞ্জন আর ফিরে না আসাই ভালো। প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠের ঐতিহ্য রক্ষায় ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আশু পদক্ষেপ নিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান স্কুলটির প্রধান শিক্ষক নূরে আলম।