বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : আলজাজিরার তথ্যচিত্রের অন্যতম আলোচিত চরিত্র সামির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজে অংশ নেওয়া, সেনানিবাসে নিষিদ্ধ হওয়াসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সামি কখনো তানভীর সাদাত, কখনো সায়ের জুলকারনাইন, কখনো বা জুলকারনাইন সায়ের খান নামে প্রতারণাসহ বহু অপরাধে জড়িত ছিলেন।
তাঁরা বলছেন, র্যাব কর্মকর্তা পরিচয়ে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে ২০০৬ সালে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সামি। সর্বশেষ গুজব ও অপপ্রচারের অভিযোগে গত বছরের মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার অন্যতম আসামি তিনি।
জানা গেছে, সামির প্রকৃত নাম সামিউল আহমেদ খান। অল্প বয়সে মাকে হারানোর পর চুরিসহ প্রতারণামূলক অপরাধে জড়িয়ে যান। বদলে ফেলেন মায়ের রাখা নাম ‘তানভীর মোহাম্মদ সাদাত খান’। সব সেনানিবাস থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার সময় তাঁর নাম ছিল ‘সামিউল আহমেদ খান’। মাদক ও অন্ধকার জগতে জড়িয়ে বেছে নেন নতুন নাম সায়ের জুলকারনাইন। কয়েক বছর ধরে জড়িয়ে পড়েন পাহাড়ি উগ্রবাদীদের সঙ্গে। এরই মধ্যে আলজাজিরা ইস্যুতে তাঁর সহপাঠী ও পরিচিতদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর মুখোশ উন্মোচন করছেন। তাঁদেরই একজন সামির ইস্পাহানি স্কুলের সহপাঠী সাইফ এম ইশতিয়াক হোসেন। ২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা ১৩ মিনিটে তিনি সামির পরিবার-স্কুল এবং পরবর্তী কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি বড় স্ট্যাটাস দেন। একই দিন বিকেল ৫টা ১৯ মিনিটে ওমর শরীফ আরেফিন নামের আরেকজন সামি সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে।
শিশুকালেই অপরাধের হাতেখড়ি : বাবা লে. কর্নেল (অব.) মো. আবদুল বাসেত খানের চার সন্তানের মধ্যে সামিউল আহমেদ খান সবার বড়। জন্ম ১৯৮৪ সালে হলেও স্কুলের কাগজপত্রে তাঁর জন্ম তারিখ ১৯৮৬ সালের ৮ অক্টোবর। ১৪ বছরে মাকে হারান। এর দুই বছর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তখন থেকেই অন্ধকার জগতে পা বাড়ান সামি। ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর ভর্তি হন কুমিল্লার ইস্পাহানি স্কুলে। ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে ড্রাগ নেওয়া, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপরাধে জড়ান।
কৈশোর থেকেই সেনানিবাসে নিষিদ্ধ : কিশোর বয়সেই চুরিতে হাত পাকান সামি। ২০০০ সালের ৩০ জানুয়ারি ইসিবিতে কর্মরত মেজর ওয়াদুদের বিদেশ থেকে আনা ট্র্যাকস্যুট চুরি করে ধরা পড়েন সামি। তখন তাঁর বয়স ১৭। ২০০০ সালের জুলাই মাসে টাইগার অফিসার্স মেস থেকে হাতির দাঁত চুরি করেন, পরে চট্টগ্রামের নিউ মার্কেটের অঙ্গনা জুয়েলার্সে বিক্রি করে ধরা পড়েন। বাবার চাকরির সুবাদে নিজেকে কখনো সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, কখনো ক্যাপ্টেন হিসেবে পরিচয় দিতেন। ২০০১ সালের ২৮ ও ২৯ এপ্রিল ঢাকা সেনানিবাসে নিজেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বন্ধু উৎপলের কাছে নিজেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট প্রমাণের জন্য বেল্ট, বুট ও র্যাংক ইউনিফর্ম কেনেন। উৎপলের বাসা থেকেই সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরে ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে সেনানিবাসসহ প্রথম আলো পত্রিকা অফিস, রাপা প্লাজা ও চিড়িয়াখানা ঘুরে জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে সিএমএইচে প্রবেশের সময় দুপুর ২টায় মিলিটারি পুলিশের (এমপি) হাতে ধরা পড়েন সামি। দুই দিন পর ২ মে বাবার অঙ্গীকারনামায় আর্মি এমপি ডেস্ক থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
র্যাব পরিচয়ে প্রতারণা-গ্রেপ্তার : ২০০৬ সালের ২০ জুলাই র্যাব কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে রাজধানীর ফার্মগেটের এজে টেলিকমিউনিকেশন থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার মোবাইল ফোন কিনে একটি ভুয়া চেক দেন। একইভাবে প্রাইজ ক্লাব নামক একটি কম্পিউটার ফার্ম থেকে ১০টি ল্যাপটপ কেনার কথা বলে দুটি ল্যাপটপের গুণগত মান দেখার কথা বলে চেক দিয়ে দুটি ল্যাপটপ নিয়ে আসেন। চেক ডিস-অনার হলে অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-১ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনার পর তাঁকে এনপিজি ঘোষণা করে সব সেনানিবাস ও দপ্তরে অবাঞ্ছিত করা হয়। এ ঘটনার পর সামিকে ত্যাজ্য করেছিলেন বাবা লে. কর্নেল (অব.) আবদুল বাসেত। ঠিক এর পরদিন ২০০৬ সালের ২৩ জুলাই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি।
একাধিক বিয়ে ও নারী কেলেঙ্কারি : সেনা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়েই এক সেনা কর্মকর্তার মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন সামি। অ্যান্টেনা ভাঙা ভিএইচএফ (ওয়াকিটকি) নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেওয়ার নামে কয়েকজনের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ছিল সামির বিরুদ্ধে। ব্যবসার কথা বলেও অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। শ্বশুরের অর্থে হাঙ্গেরিতে রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরু করার পর বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য অনেকেই সামিকে খুঁজছেন।
গুজব ও অপপ্রচারের অভিযোগে মামলা : গত বছর সাইবার ক্রাইম ইউনিট অনলাইনে জাতির পিতা, শেখ হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কটূক্তি ও আপত্তিকর প্রচারণা এবং করোনাভাইরাস নিয়ে অপপ্রচারসহ বিভিন্ন গুজব রটিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে তাদের অন্যতম সামি। ‘উই আর বাংলাদেশি’ পেজ থেকে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার অভিযোগে অভিযুক্তদের ল্যাপটপ ও মোবাইল অনুসন্ধান করে ১১ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পান গোয়েন্দারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাসনিম খলিল, সামিসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এ মামলার প্রতিবাদে কলাম লিখেছিলেন আরেক অপপ্রচারকারী ডেভিড বার্গম্যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশকে টার্গেট করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্যেই কল্পিত তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতারণা ও মিথ্যাচারে সিদ্ধহস্ত বিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে আলজাজিরার এই তথ্যচিত্র তৈরির উদ্দেশ্য কারো বুঝতে আর বাকি নেই।