বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : শিক্ষার্থীদের নতুন ও ভবিষ্যেক আলিঙ্গন করার মানসিকতা নিয়ে পরিবর্তনের কারিগর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাতারের রাজধানী দোহায় গতকাল মঙ্গলবার কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত ‘বাংলাদেশ : একটি উন্নয়ন মডেল : শেখ হাসিনার কাছ থেকে শেখা’ শীর্ষক অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নেতৃত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করুন এবং পরিবর্তনের কারিগর হোন।’
প্রধানমন্ত্রী কাতার ইকোনমিক ফোরাম ২০২৩-এ যোগদানের জন্য দোহায় তিন দিনের সরকারি সফরে রয়েছেন। তিনি গতকাল সকালে ফোরামের উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দেন।
ওই ফোরামের মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী চলমান বহুমুখী চ্যালেঞ্জ ও সংকট এবং এর ফলে উদ্ভূত বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করুন, আপন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মনোনিবেশ করুন এবং দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করুন।
আপন লোকজন এবং দলের ওপর বিশ্বাস রাখুন। আপনার মাতৃচেতনাকে জাগ্রত করুন এবং নতুন ও ভবিষ্যেক আলিঙ্গন করুন।
শেখ হাসিনা তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই। স্মার্ট বাংলাদেশে একটি স্মার্ট সরকার, একটি স্মার্ট অর্থনীতি, একটি স্মার্ট জনসংখ্যা, একটি স্মার্ট সমাজ এবং স্মার্ট জনশক্তি থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণকে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা হবে, যাতে তারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অবদান রাখতে পারে।
তিনি বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করছি। সারা দেশে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও ইনকিউবেশন সেন্টার এবং হাই-টেক পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে।’
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার একটি ন্যানো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য আইন পাস করেছে।’
ডিজিটাল ডিভাইস বা প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের সমাজে নারীদের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ একটি পরিবর্তিত বাংলাদেশ।
এটিকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, নিরক্ষরতা ইত্যাদি দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে কষ্টার্জিত উন্নয়ন কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এটা আমাদের নারী-পুরুষের সম্মিলিত কাজ। আমি শুধু তাদের কাঙ্ক্ষিত পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, তবে আজকের অবস্থানে পৌঁছানো সহজ যাত্রা ছিল না। কারণ সারা জীবন তাঁকে অনেক অগ্নিপরীক্ষা ও নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে।
১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর চালানো নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেদিন আমি এবং আমার বোন বিদেশে থাকায় বেঁচে গিয়েছি। আমার বোন এবং আমাকে ছয় বছর ধরে উদ্বাস্তু জীবন যাপন করতে হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর দল আওয়ামী লীগ তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করার পর ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও নিরক্ষরতামুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার নিয়ে দেশে ফেরেন। তিনি বলেন, ফিরে এসে তিনি খাদ্য ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন। তাঁকে বারবার অন্তরিন করে রাখা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার জীবননাশের জন্য কমপক্ষে ১৯ বার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। সবচেয়ে গুরুতর একটি ছিল ২০০৪ সালের আগস্টে, যখন আমাকে হত্যা করার জন্য আমার ওপর এক ডজন আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আমি বেঁচে গিয়েছি, কিন্তু আমার দলের ২২ জন নেতাকর্মী নিহত এবং কয়েক শতাধিক আহত হয়েছেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে তিনি শুধু তাঁর দেশবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তিনি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন, ‘আমি যত দিন বেঁচে থাকব তত দিন আমি সংগ্রাম চালিয়ে যাব, ইনশাআল্লাহ। আমার স্বপ্ন হলো আমাদের বদ্বীপকে আবারও সমৃদ্ধির দেশে পরিণত করা।’
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ পরবর্তী ২১ বছর সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের অধীনে ছিল এবং জনগণের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমার দল, আওয়ামী লীগ, ২১ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয় এবং আমি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলাম। পাঁচ বছরে আমরা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ২০০১ সালে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলাম এবং তারপর হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং সামরিক হস্তক্ষেপের আরেকটি অন্ধকার সময় অতিক্রম করতে হয়েছিল।’
তিনি বলেন, তাঁদের দল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে পুনর্নির্বাচিত হয় এবং তার পর থেকে টানা দুই মেয়াদে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমার বাবা যা চেয়েছিলেন, ‘একটি সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ’, তার জন্য আমরা গত সাড়ে চৌদ্দ বছরে বাংলাদেশকে প্রস্তুত করেছি।” শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ প্রায় সব আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি, যার জিডিপি ৪৬০.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা খাদ্য নিরাপত্তা, বিনা মূল্যে ও সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটাল পরিষেবা, প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুৎ, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও জলবায়ু অভিযোজনে সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জন করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে আমরা এখন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ব্যাপারে বিশ্বের সেরা ১০টি দেশের মধ্যে আছি। বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও সংসদ উপনেতার সবাই নারী।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল কাতারের দোহায় র্যাফেলস টাওয়ারের দ্বিপক্ষীয় সভাকক্ষে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান বিন জসিম আল থানির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।