বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বিশ্বে জঙ্গিবাদ দমনে অনন্য নজির গড়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দীর্ঘ সাত বছর ধরে দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযানে এই সাফল্য অর্জন করেছে। বৈশ্বিক ইনডেক্সে হাই রিস্কের (উচ্চ ঝুঁকি) দেশ থেকে লো রিস্কের (নিম্ন ঝুঁকি) দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) তত্ত্বাবধানে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করলেও তা যৌথ বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মুখে অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে। গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স (জিটিআই)-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী এর সূচকে বাংলাদেশ তিন ধাপ উন্নতি করেছে। অর্থাৎ দেশে সন্ত্রাসবাদ আরও কমেছে, দেশ আরও নিরাপদ হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো করা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও ভারতের চেয়েও জঙ্গি দমনে ভালো করেছে বাংলাদেশ। রাজধানীর গুলশান হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর দীর্ঘ সাত বছরে বিচ্ছিন্ন দুই একটি ঘটনা ছাড়া দেশে বড় ধরনের কোনো জঙ্গি হামলা ঘটেনি। জঙ্গিবাদ পুরাপুরি নির্মূল না হলেও জঙ্গি সংগঠনগুলোর মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে বেশকিছু জঙ্গি সংগঠন। দেশের জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি।
জঙ্গিবাদ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জঙ্গিরা সংগঠিত হয়ে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থা। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার উত্থান চেষ্টার পর তাদের নির্মূল না করা পর্যন্ত হুমকি ও ঝুঁকি দুইটাই রয়ে গেছে। এ ছাড়া গত বছরের নভেম্বরে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশের চোখে-মুখে পিপার স্প্রে করে প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই আসামি সুনামগঞ্জের ছাতকের মইনুল হাসান শামীম ও লালমনিরহাটের আদিতমারীর আবু ছিদ্দিক সোহেলকে ছিনতাই করে নিয়ে যায় তাদের সহযোগী জঙ্গিরা। এখনো ছিনিয়ে নেয়া জঙ্গিসহ সহযোগী অনেক জঙ্গিই এখনও অধরা। অনেক জঙ্গি জামিন নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। একাধিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের জোট বেঁধে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির তথ্যও পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অনলাইনে সক্রিয় হয়ে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে গোপনে সদস্য সংগ্রহ করছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। জঙ্গিদের গোপন কার্যক্রমের তথ্য পেলেই অভিযান পরিচালনা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনলাইনে সরব রয়েছে এমন জঙ্গি সংগঠনগুলোর দাওয়াতি কার্যক্রম, সদস্য সংগ্রহ ও উগ্রবাদী প্রোপাগান্ডা চালানো, সাংগঠনিক যোগাযোগের জন্য নিত্যনতুন এনক্রিপ্টেড অ্যাপস ব্যবহার করছে জঙ্গিরা। জঙ্গি দমনে সাইবার জগতে নজরদারি জঙ্গি দমনে চালানো হচ্ছে সাইবার জগতে নজরদারি ও মনিটারিং।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার। দেশে এখনো পর্যন্ত জেএমবি, শাহাদাত-ই-আল-হিকমা, জেএমজেবি, হিজবুত তাহরির, হুজি-বি, এবিটি, আনসার আল ইসলাম এবং আল্লাহ দল নামে আটটি জঙ্গি সংগঠনকে বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারের কঠোর ভূমিকার কারণে দেশের জঙ্গিবাদ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর সাঁড়াশি অভিযান শুরু করার পর একে একে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে নিহত হয় একাধিক শীর্ষ নেতাসহ অনেকেই। এরপর নব্য জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলো কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। জঙ্গিবাদ দমনে ২০১৬ সালে গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার আগে জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশের তেমন দক্ষতা ছিল না। এরপর গঠন করা হয় পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট, ডিএমপির কাউন্টার-টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, সাইবার ক্রাইম, ইনভেস্টিগেশন সেন্টার এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ইন্টারসেপশন ইউনিট জঙ্গিবাদ দমনে সরাসরি কাজ করছে। র্যাব, পুলিশ, এনটিএমসি এবং সাইবার টিম সকল প্রকার উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে একসঙ্গে কাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে জঙ্গিদের তৎপরতা ঠেকাতেও সতর্ক রয়েছে এসব বাহিনী।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জঙ্গিরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। জঙ্গিদের অনলাইন ও অফলাইন কার্যক্রম সবসময় নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সাল থেকে ২০২৩ সাল গত ২২ বছরে সারাদেশে জঙ্গিবাদ বিষয়ক প্রায় ২ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯ হাজারেরও বেশি জঙ্গি। এসব জঙ্গিরা হচ্ছে জেএমবি, নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, হরকত-উল-জিহাদ হুজি, হিযবুত তাহরির, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিকল্পনা করে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে যার মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন এবং প্রাসঙ্গিক আইন সংশোধন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৯-২০১৩ সালে, ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ পুরোহিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, ভিন্নমতের ইসলামী মতাদর্শের অনুসারী, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা এবং বিদেশীদের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ দেশে জঙ্গিবাদ বিরোধী কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছিল। তবে এখনো পুরনো জঙ্গি সংগঠন জএমবি, আনসার-আল ইসলাম ও হুজিবি সংগঠিত হওয়ার সময়ে অনেক জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে। নব্য জেএমবির সর্বশেষ আমির মেহেদি হাসান জন তুরস্কে বসে সংগঠনটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
জঙ্গিবাদ নিয়ে তদন্ত করছেন এমন কর্মকর্তারা বলেছেন, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামীন মাহফুজকে তার স্ত্রীসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই জঙ্গি সংগঠনটির আমির আনিচুর রহমান ওরফে মাহমুদসহ পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া পনেরো থেকে বিশ জন প্রশিক্ষিত জঙ্গি এখনো অধরা। জঙ্গিরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময় দেখা যাচ্ছে তারা অনলাইনে অ্যাকটিভ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নতুন সদস্য সংগ্রহ, সমর্থক সংগ্রহ করতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটিইউ এর অনলাইনে পেট্রলিংয়ের মাধ্যমে জঙ্গি তৎপরতার বিষয় দেখা যাচ্ছে। সাইবার পেট্রলিং এর মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। গ্রেপ্তার করে তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে র্যাবের সাফল্য রয়েছে। তবে সংস্থাটি কোনো আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে না। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ মাথচাড়া দিয়ে ওঠার কোনো সুযোগ নেই। সাইবার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে জঙ্গিদের কার্যক্রমেও নজরদারি রাখা হচ্ছে।