বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় এবার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার। যেখানে থাকছে টেকসই উন্নয়ন ও স্মার্ট জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার নানা পরিকল্পনা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকে স্বনির্ভর ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করা এবং তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিকেও প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সহজলভ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা আনা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতি রোধের বিষয়গুলোকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ইশতেহারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগামী ২৭ ডিসেম্বর ঘোষণা করা হবে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার। বরাবরের মতো এবারও ইশতেহার ঘোষণা করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির মাধ্যমে তৈরি ইশতেহারের খসড়া তুলে দেওয়া হয়েছে দলীয় প্রধানের হাতে। কিছু খুঁটিনাটি সংশোধন এবং সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে সেটি প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছেন তিনি। দু-এক দিনের মধ্যে এটি চূড়ান্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল গত ২৭ সেপ্টেম্বর। ওই দিন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাককে আহ্বায়ক এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদকে সদস্য সচিব করে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটি গঠন করা হয়। এই উপকমিটি কয়েক দফা বৈঠকের পাশাপাশি ইশতেহার প্রণয়নে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়েছে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কৃষক, শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের দাবি ও প্রত্যাশার কথাও জেনেছে আওয়ামী লীগ।
ইশতেহার প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহারেই জাতির সামনে একটি আশা জাগানিয়া ও অনুপ্রেরণামূলক স্লোগান তুলে
ধরে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের ইশতেহারের স্লোগান ছিল– ‘দিন বদলের সনদ’। যেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে ছিল– ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি অগ্রাধিকার হিসেবে ১০টি মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছিল সেখানে। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারের স্লোগান ছিল– ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। যেখানে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও ২১০০ সালের মধ্যে ‘নিরাপদ বদ্বীপ’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছিল। আর এই তিনটি নির্বাচনী ইশতেহারই দেশের জনগণ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে।
আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের এবারের ইশতেহারের মূল স্লোগান নির্ধারিত হয়েছে– ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। যেখানে বরাবরের মতো অনেক চমকও থাকছে– এমনটাই জানিয়েছেন ইশতেহার প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট নেতারা।
যা থাকছে নির্বাচনী ইশতেহারে
ইশতেহারের প্রথমাংশে থাকবে গত নির্বাচনের অঙ্গীকারের বাস্তবায়নের চিত্র। তুলে আনা হবে বিএনপি সরকারের সঙ্গে টানা তিন মেয়াদে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তুলনামূলক চিত্র। আর দ্বিতীয়াংশে থাকছে আবারও ক্ষমতায় আসতে পারলে আগামী পাঁচ বছর মেয়াদে কী কী করা হবে, সেসব অঙ্গীকার। পাশাপাশি থাকবে ভবিষ্যতের কিছু রূপরেখাও। সেখানে খুব সুনির্দিষ্টভাবে বলা থাকবে পাঁচ বছর পর জনগণের জন্য কী করা হবে বা ১০ বছরে কী করা হবে। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে যাওয়া বাংলাদেশকে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ ও আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিও পুনর্ব্যক্ত করা হবে।
ইশতেহার প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট নেতারা আরও বলছেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ঘোষিত ‘দিন বদলের সনদ’ স্লোগান সংবলিত ইশতেহারে প্রতিশ্রুত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তব রূপ পেয়েছে বেশ আগেই। গত ১৫ বছরে বদলে যাওয়া এই বাংলাদেশকে এবার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ রূপ দেওয়ার প্রত্যয়ে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণীত হচ্ছে। এ জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে শব্দ, ভাষা ও প্রেক্ষিতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি ‘ডিজিটাল’কে ‘স্মার্ট’ সেবায় রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। ফলে গত ইশতেহারগুলোর তুলনায় এবারের ইশতেহারে বড় ধরনের কিছু মৌলিক পরিবর্তনও আনা হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিতে প্রাধান্য পাবে সর্বত্র স্মার্ট ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার রোডম্যাপ। যেখানে ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সোসাইটি’, ‘স্মার্ট ইকোনমি’ এবং ‘স্মার্ট সরকার’ প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো থাকছে। এ ক্ষেত্রে ক্যাশলেস, সার্কুলার, উদ্যোক্তামুখী, জ্ঞানভিত্তিক, গবেষণা ও উদ্ভাবননির্ভর বিষয়গুলোর পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগ আকৃষ্টের জন্য শিল্পায়নে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
ইশতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগানোর নানা পরিকল্পনার কথা থাকছে। যেখানে তরুণদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী স্মার্ট জনশক্তি তথা সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তরুণদের কর্মসংস্থান, তরুণ ব্যবসায়ীদের জন্য নানা সুবিধা এবং উদ্যোক্তাদের জন্য নানা প্রকল্প গ্রহণের বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরা হচ্ছে।
বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে ইশতেহারে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে থাকছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারাবিশ্বে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করে বাংলাদেশের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করা এবং যুগান্তকারী উন্নয়নের সুফল যাতে মানুষ পায়, সেটা নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। জিডিপি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ৮ ভাগের ওপরে। যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে বুলেট ট্রেনের পাশাপাশি মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও থাকবে ইশতেহারে। সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার পরিকল্পনাও থাকছে।
সুশাসন প্রণয়নের অঙ্গীকার পূরণে ইশতেহারে থাকছে দুর্নীতি প্রতিরোধের দৃঢ় ঘোষণা। পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষা ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা আরও কীভাবে সুদৃঢ় করা যায়, তার সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। বিদেশে যারা টাকা পাচার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টিও থাকবে। এতে জ্বালানি সংকট মোকাবিলার পরিকল্পনাও বিশদভাবে থাকছে। শহর ও গ্রামের মানুষের জন্য সত্যিকারের রাষ্ট্রীয় সেবা নিশ্চিত করার বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কৃষি, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, নতুন অবকাঠামো নির্মাণ, বিদেশনির্ভরতা কমানো এবং বিদেশি ষড়যন্ত্র রোধে নানা কর্মসূচি গ্রহণের কথাও থাকছে ইশতেহারে।
ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক ড. আব্দুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইশতেহার প্রণয়ন করে। এতে অতীতে কী করেছি ও কী অর্জন করেছি এবং ভবিষ্যতে কী করব, সেটা আমরা মূল্যায়ন করি। সেই আলোকে এবারও নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করা হচ্ছে, যার মূল থিম থাকবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। এ ছাড়া সুশাসন তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাকেও ইশতেহারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বৈশ্বিক সংকটের কারণে আমরা কঠিন সময় পার করছি। তাই ইশতেহারে কৃষি, সেবা, শিল্প খাতসহ বিভিন্ন খাতেও প্রাধান্য দেওয়া হবে।
ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির সদস্য সচিব ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, এবারের ইশতেহার প্রণয়নে সাধারণ জনগণ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত নেওয়া হয়েছে। তারা অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কৃষি, শিক্ষা এবং দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট লাঘবে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে বলেছেন। ইশতেহারে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা তুলে ধরা হবে। তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারি ও যুদ্ধ বৈশ্বিক মন্দা, অস্থিরতা ও স্থবিরতা তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অর্থনীতির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকবে। যার সুফল পাবে আগামী কয়েকটি প্রজন্ম।