পাবনা জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে যে কয়েকজন মানুষ তাদের নিষ্ঠা, সততা ও কর্ম দক্ষতার নজির সৃষ্টি করে সারাজীবন জনমুখী কর্মকাণ্ডে নিবেদিত থেকে জনগণের হৃদয়ে আসীন হয়েছেন; তাদের অন্যতম সুজানগর উপজেলার কৃতি সন্তান মরহুম আহমেদ তফিজ উদ্দিন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি ৬৯, পাবনা-২ নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনবার সংসদ সদস্য ও দুইবার সুজানগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেছেন।
এছাড়া সুজানগর উপজেলার তিনটি বৃহৎ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে এ অঞ্চলের শিক্ষাঙ্গনে সফল ও আদর্শ শিক্ষকের প্রতীক হয়ে আছেন। সরকারি চাকরি, শিক্ষকতা ও রাজনৈতিক অঙ্গন সকল ক্ষেত্রেই আপন কর্মকাণ্ড তাঁকে পৌছে দিয়েছে সফলতার স্বর্ণ শিখরে।
আহমেদ তফিজ উদ্দিন ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের তারাবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুস শুকুর মন্ডল এবং মাতা ভায়লা বানু। নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। অতঃপর পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে পড়াশোনা করে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আইএসসি ও ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বিএসসি পাশ করেন। উক্ত কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজের। ছাত্র সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিটি) প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। বিএসসি পাশ করার পরে তিনি সরকারি চাকরিতে (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়াজা অধিদপ্তরে) যোগদান করে করাচিতে গমন করেন। সে সময়ে তিনি করাচিস্থ East Pakistan Association-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। নিজ এলাকার মানুষের প্রচণ্ড অনুরোধে এলাকার শিক্ষাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে সরকারি চাকরি ছেড়ে এলাকায় আসেন। তিনি সুজানগর উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক (০১-০২-১৯৬২ খ্রি. থেকে ৩০-০৮-১৯৬২ খ্রি.) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে সাতবাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন (৩১-১২-১৯৬৯ খ্রি. পর্যন্ত)।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে সাহসী ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। ২৮ মার্চ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাবনা শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিকামী মানুষের তুমুল যুদ্ধ চলাকালে তিনি সুজানগর থেকে ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করে (লাঠি, ফালা, হাঁসি, তলোয়ার ও সুজানগর থানা থেকে সংগ্রহকৃত অস্ত্র) পাবনা শহরে গমন করে সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এপ্রিল মাসে ভারত গমন করেন। তিনি ভারতের কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পের সার্বিক দায়িত্বে (In charge) ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতা বিরোধীরা তাঁর পৈতৃক বাড়িটি সম্পূর্ণরূপে ভষ্মীভূত করে দেয়। স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরে এসে বসবাসের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পাবনা শহরের আদম লিমিটেড ভবনের দোতালায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। পরবর্তীতে সাতবাড়িয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন বাড়িটি নির্মাণ করে আমৃত্যু সেখানে বসবাস করেন।
স্বাধীনতার পরে যুদ্ধবিধস্ত দেশ গঠনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে সাতবাড়িয়া বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। উক্ত পদে থাকা অবস্থায় ১৯৮৫ ও ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে পর পর দুবার সুজানগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে সাতবাড়িয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালযের প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর থেকে আমৃত্যু তিনি সুজানগর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন। সাতবাড়িয়া কলেজ, সাতবাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয় ও সাতবাড়িয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডি/ম্যানেজিং কমিটির তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা।
শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সফল। এই সফলতাই তাঁর ছাত্র-ছাত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে তাঁর বিশাল ভাবমূর্তির পাহাড় গড়ে দিয়েছে এবং সেই ভাবমূর্তির উপর ভিত্তি করেই তিনি হয়েছিলেন এই এলাকার জনগণ নন্দিত অবিসংবাদিত নেতা। তিনি বলেছিলেন, “এমন কোনো ধনাঢ্য বা খ্যাতিমান পরিবার থেকে আমি আসিনি, শিক্ষক হিসাবে আমার যে সফলতা তার উপরে ভিত্তি করেই আমার রাজনীতিতে আসা।” তিনি সাতবাড়িয়া কলেজ ও সাতবাড়িয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মানুষ এবং রাজনীতিবিদ হিসাবে তিনি ছিলেন নির্লোভ। ধন-সম্পদের লোভ তাঁকে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর নির্লোভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বন্ধু-শত্রুসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে স্বীকৃত ও প্রশ্নাতীত। তিনবার সংসদ সদস্য ও দুইবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন- এমন একজন ব্যক্তির রেখে যাওয়া বাড়ি-ঘর ও অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দেখলেই তাঁর চরিত্র সম্পর্কে জানতে আর কোনো অসুবিধা থাকে না।
দক্ষ প্রশাসকের পাশাপাশি তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, সদালাপী, নিরহংকার, আইন ও নিয়ম-নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রচার-বিমুখ একজন মানুষ। তিনি নিজে যেমন কোনো দিন দায়িত্বে অবহেলা করেননি, অন্য কারো দায়িত্বে অবহেলা প্রশ্রয় দেননি। যে- কোনো অবস্থায় যে-কোনো মানুষ তাঁর সাথে কথা বলতে পারত। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল প্রশ্নাতীত। নিজের বিশ্বাস ও ন্যায় বোধের সাথে তিনি কখনও আপোষ করেননি। তিনি ছিলেন একজন মেধাসম্পন্ন ও পরিশ্রমী কর্মবীর। বয়স হওযার পরেও তাঁকে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখা যায়। তিনি একই সাথে সাতবাড়িয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, সুজানগর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সুজানগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। একসাথে তিনটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর দায়িত্ব পালনে কোনো ঘাটতি ছিল না। গণিত বিষয়ের শিক্ষক হওয়া সত্বেও প্রয়োজনে যে-কোনো বিষয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করার সক্ষমতা তাঁর ছিল এবং তিনি তা করতেন। সাতবাড়িয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতাকালীন অধ্যক্ষ জনাব ফজলুল হক বলেন, “প্রতিষ্ঠালগ্নে সাতবাড়িয়া কলেজে গণিতের শিক্ষক না থাকায় হাইস্কুলের শিক্ষক হয়েও আহমেদ তফিজ উদ্দিন কলেজে গণিত ক্লাসে পাঠদান করতেন।”
তিনি তার নির্বাচনী এলাকার অধিকাংশ সাধারণ মানুষকে চিনতেন। নিজে মোটর সাইকেল চালিয়ে নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। দলমত নির্বিশেষে তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। নিজ অঞ্চলের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে তিনি গ্রামেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারণেই শহরে বাড়িঘর করে বসবাস করার ইচ্ছা বা সামর্থ কোনোটাই তাঁর ছিল না।
তাঁর স্ত্রী ফিরোজা বেগম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের তিন পুত্র ও তিন কন্যা সন্তান রয়েছে। তাঁদের জৈষ্ঠ পুত্র আহমেদ ফিরোজ কবির বর্তমানে ৬৯, পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য। জনাব আহমেদ ফিরোজ কবির তাঁর প্রয়াত পিতার অনাড়ম্বর জীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে আমার বাবা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় সাতবাড়িয়া বাজারস্থ তফশিল অফিসে একজন নতুন নায়েব এসে যোগদান করেন। এলাকায় তখন পর্যন্ত বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপিত না হওয়ায় মানুষ ছিল হারিকেনের উপর নির্ভরশীল। সন্ধ্যাবেলা নবাগত নায়েব সাহেবের হারিকেনে তেল ভরার প্রয়োজন হলে তার অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া লুঙ্গি-ফতুয়া পরিহিত উপজেলা চেয়ারম্যানকে অতি সাধারণ কোনো মানুষ ভেবে তাঁর হাতে হারিকেন ও পাঁচটা টাকা দিয়ে তেল ভরে এনে দিতে বলেন এবং নায়েব সাহেব তার প্রত্যাশা অনুযায়ী তেল ভরতি হারিকেন ফেরত পান। পরক্ষণে নায়েব সাহেব যখন জানতে পারেন যে, তিনি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও একজন সাবেক সংসদ সদস্যকে দিয়ে তেল আনিয়েছেন, তখন তার লজ্জাবোধের সীমা কোনো পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে- তা সহজেই ধারণা করা যায়।”
সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আপন কর্ম মহিমায় এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে অনন্তকাল তিনি বেঁচে থাকবেন এবং প্রগতির আলো ছড়াবেন।
মো. মনসুর আলী: লেখক; জন্ম: ২৯ জানুয়ারি, ১৯৬৯ খ্রি.: ঠিকানা: সুজানগর পৌরসভা, সুজানগর, পাবনা।