পাবনা প্রতিনিধি : পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় পদ্মা নদী থেকে অবৈধ ভাবে কমপক্ষে ৪০টি ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে প্রভাবশালী মিলন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ক্ষমতাধর মহল বালু উত্তোলন করে সরকারের বিপুল পরিমান রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আইন লঙ্ঘন করে পদ্মা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও তীর সংরক্ষণ বাঁধের খুব কাছ থেকে অবৈধভাবে এই বালু উত্তোলন করায় বাঁধটি হুমকির মুখে পড়েছে।
সরকারের বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের ৪ (খ) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনার এক কিলোমিটারের মধ্য থেকে বালু তোলা যাবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি বিধি ও আইনের তোয়াক্কা না করে জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের সাহেব নগর গ্রাম থেকে সীমান্তবর্তী নাটোরের লালপুর উপজেলার চরমহারদিয়া গ্রাম পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার অংশে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের উপস্থিতিতে ওই নেতা বালু তুলছেন বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন। এভাবে বালু উত্তোলন করার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে ভাঙন ও বন্যা কবলিত মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল সাঁড়া ইউনিয়ন তীর সংরক্ষণ বাঁধ।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাঁড়া ইউনিয়নের পাথরঘাট, সাঁড়া ঝাউদিয়া, সাঁড়া পশ্চিম থেকে লালপুর উপজেলার চর মহাদিয়ার, জর্জিয়া ও ভেড়ামারা থানার চর গোলাপনগর এবং চরদিয়ার বাহাদুরপুর পর্যন্ত কমপক্ষে ৪০টি ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন চলছে। বালু তোলার পর মাহিন্দ্র ট্রাক্টর ও শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ভটভটি বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিটি স্থানেই বাঁধের ১০০-১৫০ মিটারের মধ্য থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব ড্রেজারে লস্কর, মাস্টার ও সুকানি ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি।
বালু উত্তোলনকালে কথা হয় রংধনু নামের একটি ড্রেজারের লস্কর খাজা ইউনুস খান, ব্যবস্থাপক মিরাজ ও গজারিয়া নামের ড্রেজারের মাস্টার আলেকের সঙ্গে। তারা বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ভাগ দিয়ে তাঁরা বালু উত্তোলন করছেন। একটি ড্রেজার দিয়ে প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ ঘনফুট বালু তোলা যায়। এই বালু বিক্রির টাকার ৫০-৭০ শতাংশ নেতাদের দিতে হয়। তবে তারা এসব নেতার নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাঁড়া ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের কয়েকজন স্থায়ী বাসিন্দা জানান, বালু দস্যুরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তাদের বাধা দেওয়ার সাহস করছেন না। তারপরও তারা বালু উত্তোলনে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তারা তা না মেনে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নদীর গভীর থেকে বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছেন।
স্থানীয় লোকজন বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে বালু তোলা হচ্ছে। প্রতিদিন ৫০টি গাড়ি লোড করে উত্তোলনকৃত বালু বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিটি গাড়িতে ১০০ ঘনফুট বালু পরিবহণ করা যায়।
সাঁড়া গ্রামের বাসিন্দা আজাদ মিয়া বলেন, এক সপ্তাহ ধরে তার ১০ শতাংশ জমি থেকে লোকজন বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছেন। বাঁধা দেওয়ায় ওই নেতার পক্ষেই কয়েকদিন আগে ঈশ্বরদী থানার পুলিশ এখানে আসে। পরে পুলিশের উপস্থিতিতেই অবৈধভাবে তার জমি থেকে বালু নিয়ে যাওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফিরোজ কবির বলেন, বালু উত্তোলন প্রক্রিয়ার সঙ্গে পুলিশের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে কোনো পুলিশ সদস্য এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পাবনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী কেএম জহুরুল হক বলেন, বিষয়টি উপজেলা প্রশাসক বন্ধ করতে পারেন। তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাঁড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এমদাদুল হক রানা সরদার বলেন, সাঁড়া ভাঙন কবলিত ইউনিয়ন। ভাঙন প্রতিরোধ ও তীর সংরক্ষণের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। অথচ নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে সাঁড়া এখন হুমকির মুখে। তিনি বলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ থেকে রক্ষায় এবং কৃষি জমি বাঁচিয়ে জমির মালিকদের কৃষি চাষের জন্য প্রশাসনের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিহাব রায়হান বলেন, গ্রামবাসীর অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বালু উত্তোলন আপাতত বন্ধ রাখতে বলেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
ঈশ্বরদী সহকারী কমিশনার (ভূমি) মমতাজ মহল জানান, সাড়া ইউনিয়নের ইসলামপুরে বালু নিলামে দেয়া হয়েছে। অন্যস্থানগুলোর বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। আমার কাছে এ ধরণের কোন অভিযোগ আসেনি। তারপরও খোঁজ নিয়ে অভিযোগ প্রমানিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে একাধিক সূত্র দাবী করছে, পদ্মা নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলনের পেছনে প্রভাবশালীদের তালিকায় ঈশ্বরদী উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বিশ্বাস, পৌর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ইসহাক মালিথা ও লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছ মোল্লাসহ বেশ কয়েকজন জড়িত রয়েছেন। মূলত এদের মদদেই উপজেলা ও জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনকে অনৈতিক ভাবে ম্যানেজ করে সরকারের বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে এই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে মুঠোফোনে কাউকে পাওয়া যায়নি।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারী প্রভাবশালী মিলন চৌধুরীর সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য নেয়া যায়নি।