মেহেদী হাসান আকন্দ: যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শেষ সৈনিকটিও পালাতে পারে। কিন্তু তখনও সাংবাদিককে থাকতে হয় সেই পলায়নের খবর অন্যদের জানাতে। তাই অবকাশ যাপনে গিয়েও আমাদের চোখ-কান খোলা থাকে। পশ্চিমা প্রবাদে বলা হয়ে থাকে, সায়েন্স নেভার স্লিপস। অথাৎ বিজ্ঞান কখনো ঘুমায়না। এই কথা সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে আরোও বেশি সত্য। ঘুমায়না শুধু নয় সংবাদমাধ্যম ঘুমানোর কথা চিন্তাও করেনা।
বিশ্বজুড়ে অজানা আতংক করোনাভাইরাসের তান্ডবে প্রায় সবাই যখন ঘরবন্দি, সাংবাদিকরা তখনও সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনে ছুটে বেড়াচ্ছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বৈশ্বিক ঘটনাবলি যখন সাধারণ নাগরিক কিংবা অন্যান্য পেশার জন্য সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, দেখা-শোনা, আলোচনা-সমালোচনার বিষয়, সংবাদমাধ্যমের জন্য তখন তা ‘ইভেন্ট’ মাত্র। সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনে নিয়োজিত সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বের কাছে ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি একেবারেই তুচ্ছ। একারণেই সাংবাদিকতা অন্যান্য পেশা থেকে আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। মর্যাদাপূর্ণ এই পেশায় যারাই জড়িত তারা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে পেশাদারিত্বের সবটুকু উজাড় করেই দিয়ে থাকেন। কি পাবেন, কি পেলেন না; সেসব নিয়ে খুব কম সাংবাদিককেই ভাবে।
করোনাভাইরাসের মহামারিতে দায়িত্ব পালন করতে করতে মৃত্যুও হয়েছে সাংবাদিকের। তবুও থেমে নেই সংবাদকর্মীদের যুদ্ধ। খবরের পেছনের খবর পেতেই ছুটে চলছেন বিরামহীনভাবে। সাংবাদিকরা প্রতিদিনই এক একটি নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, প্রতিদিনই তাদের জন্য এক একটি পরীক্ষা। বিশ্বব্যাপীই রাজনৈতিক জরুরি অবস্থা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ- যে কোনো পরিস্থিতিতেই প্রতিমুহূর্তের খবর তুলে আনতে তারা নিরলসভাবে কাজ করে। যুদ্ধ, সংগ্রাম, নির্বাচন, সমঝোতা, অস্ত্রবিরতি, পরমাণু প্রতিযোগিতা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, দাবানল, জলবায়ু পরিবর্তন, জীবজগৎ, রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, আবিষ্কার, পুরস্কার- সবকিছুতেই থাকতে হয় তাদের আক্ষরিক অর্থেই নখদর্পণে। তার মানে এই নয় যে, সাংবাদিকরা নিছক তথ্যযন্ত্র। তারাও রক্তমাংসের মানুষ। তারা কাজ করে চলছে মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজনের নানা আবেগকে উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে। সাংবাদিকরা মহামারি মোকাবিলায় ‘ফ্রন্টলাইনের’ যোদ্ধা।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাংবাদিকরা করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ন্যূনতম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া সংবাদ সংগ্রহের স্বার্থে দিন-রাত কাজ করে চলছেন। সাংবাদিকতা নিছক একটি পেশা নয়, বরং এটি লাইফস্টাইলের নামান্তর। অনেকের কাছে জীবন ও সাংবাদিকতা সমার্থক। তাইতো তারা যেকোনো ঝুঁকি নিতে পারে।
কেবল রাজনৈতিক সংকট নয়, বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগও যেন বাংলাদেশের নিয়তি। প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশকে অন্তত একটি প্রলয়ঙ্করী বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বড় ঘূর্ণিঝড়ের পরম্পরা বা ফ্রিকোয়েন্সি এখন আরও বেড়েছে। কয়েক বছর পরপরই বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে আমাদের উপকূলে। আগাম বন্যা এসে খেয়ে যাচ্ছে হাওরাঞ্চলের ধান। দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে নদীভাঙন। স্বাভাবিকভাবেই সংবাদমাধ্যমকে এসব দুর্যোগ স্পর্শ করে। কিন্তু সাংবাদিকরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, সেসব দুর্যোগ নিয়েই সময়োচিত সংবাদ ও উপযুক্ত বিশ্নেষণ তুলে ধরে। নিজেদের শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এদেশের সংবাদমাধ্যম দায়িত্ব পালনে, দায়িত্বশীল আচরণে কখনও পিছপা হয়নি।