পাবনায় শিক্ষার্থীদের নগদ ও বিকাশে পাঠানো উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র

পাবনা প্রতিনিধি : পাবনা শহরের গোবিন্দা মহল্লার নাজমুল হক মামুন। তার শিশুপুত্র অর্পণ শহরের পৈলানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। তিনি প্রয়োজনে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। নগদ কখনো ব্যবহার করেননি। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করার পর সম্প্রতি তিনি মোবাইল ম্যাসেঞ্জে জানতে পারেন, সরকারি ভাবে ছেলের নামে টাকা এসেছে।

গত বৃহস্পতিবার তিনি নগদে আসা টাকা বের করার জন্য মহল্লার পাশে গোবিন্দায় দোকানে গিয়ে টাকা বের করার মোবাইল ফোনটি ধরিয়ে দিলে দোকানদার জানান, আপনার টাকা আগেই উত্তোলন করা হয়েছে। ব্যালেন্সে কোন টাকা নেই। নাজমুল হক মামুন বলেন, কখনো নগদ খুলিনি। তাহলে কে খুললো আর কে উঠায়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, তার নাম্বারে সরকারি ভাবে ৯০০ করে ২ বার ১৮০০ টাকা এসেছে। দুইদিন আগে এসেছে ৪৫০ টাকা। কিন্তু কোন টাকাই তিনি উত্তোলন করতে পারেননি।

নগদ ও বিকাশ একাউন্টে টাকা আসলেও পাবনার বিভিন্ন স্থানেই অভিযোগ উঠেছে একটি প্রতারক চক্র কৌশলে শিক্ষার্থীদের আসা ওই সকল উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ঘটনাটি শুধু গ্রামাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন শহর পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ভূক্তভোগীদের দাবী, পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর হস্তে প্রতারকচক্র দমনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা সহজ-সরল এবং কিছুটা অসচেতন হওয়ায় সহজেই বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টের পিন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য প্রতারকদের দিয়ে দিচ্ছে। গত এক সপ্তাহে জেলায় কমপক্ষে শতাধিক এ ধরণের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।

শিক্ষার্থী, বিকাশ ও নগদ এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সপ্তাহ খানেক হলো চতুর্থ শ্রেণি, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিকাশ একাউন্টে উপবৃত্তির টাকা আসছে। এর মধ্যে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি ও করোনাকালীন সহায়তা মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছে।

কমপক্ষে ১০/১২ জন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, বিকাশ বা নগর অ্যাকাউন্টে টাকা আসার পর মুঠোফোনের অপরিচিত নম্বর থেকে প্রতারক চক্রের কল আসে। সেখানে বলা হয়, ‘হ্যালো আমি বিকাশ থেকে বলছি। আমাদের এখানে সিকিউরিটি প্রবলেম হচ্ছে। আমরা আপনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেব। তার আগে দেখেন- আপনার অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তির টাকা ঢুকেছে কিনা। যদি টাকা ঢুকে থাকে, তবে ওই টাকা আপনি তুলতে পারবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাদের অফিস থেকে সিকিউরিটি পাসওয়ার্ড চেঞ্জ না করে নেবেন।’

এ ধরণের বক্তব্য দিয়েই প্রতারকেরা কথা শুরু করে গ্রামের সহজ-সরল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। এরপর কথার মার-প্যাঁচে কৌশলে পিন নম্বর সংগ্রহ করে হাতিয়ে নেয় বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টের সব টাকা। গত এক সপ্তাহের মধ্যে জেলার বেড়ার প্রত্যন্ত এলাকায় এ ধরনের শতাধিক ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে কাশিনাথপুর ও আমিনপুর এলাকার শুধু ছয় থেকে সাতজন বিকাশ একাউন্টের সঙ্গে কথা বলেই অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থীর প্রতারিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে জেলা সদরের চিত্র একই অবস্থা। শহরের নারায়নপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কৃষ্ণপুর ও গোবিন্দা এলাকাতেও প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর বিকাশ ও নগদ নম্বর থেকে প্রতারকচক্র টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন উপজেলাতেও একই ধরণের অভিযোগের খবর পাওয়া গেছে।

পাবনা শহরের গোবিন্দার নগদ এজেন্ট ফারুক বলেন, বেশ কিছু অভিভাবক আমার কাছে এসেছেন টাকা বের করে নেয়ার জন্য। কিন্তু তাদের কারও অ্যাকাউন্টে টাকা নেই। কে বা কারা এই টাকা বের করে নিচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সচেতন ব্যক্তি জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সাথে বিকাশ ও নগদ এজেন্ট খোলার জন্য অনেক সময় বিকাশ ও নগদের মাঠ কর্মিরা যোগাযোগ করে। প্রতিটি অ্যাকাউন্ট খুললে তারা কমিশন পায়। তাদের ধারণা, বিকাশ ও নগদের মাঠ কর্মি পর্যায়ের চুক্তি ও কমিশন ভিত্তিক লোকজন এই প্রতারণার সাথে জড়িত থাকতে পারে।

বেড়া উপজেলার কাশিনাথপুর ফুলবাগান মোড়ে বিকাশের কাস্টমার কেয়ারের সামনে দাঁড়ানো একাদশ শ্রেণির তিন শিক্ষার্থী জানায়, বিকাশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি কৌশলে তাদের কাছ থেকে পিন নম্বর নিয়ে উপবৃত্তির সব টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ কারণে তারা এখন বিকাশের কাস্টমার কেয়ারে এসেছে। কিন্তু এখানে ধর্ণা দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।

শাহিন আলম নামের একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, গত সোমবার সকালেই বিকাশ কাস্টমার কেয়ারের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি তাকে ফোন করেছিল। এতে সে সরল বিশ্বাসে ওই ব্যক্তির কথামতো তথ্য দিয়েছে। তথ্য না দিলে তার বিকাশ অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় দেখানো হচ্ছিল। এই ঘটনার কিছু সময়ের মধ্যেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা খোয়া যায় ওই শিক্ষার্থীর।

কাওছার আহমেদ নামের আরেক শিক্ষার্থী বলে, ‘আমার বিকাশে আগেই কিছু টাকা ছিল। গত রোববার উপবৃত্তির সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা আসে। সব মিলিয়ে আমার বিকাশে ১০ হাজার টাকা ছিল। করোনাকালীন এই দুঃসময়ে এই টাকা আমার ও পরিবারের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রতারকেরা আমার সব কিছু কেড়ে নিল।’

এদিকে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে জানায়, তাদের বিকাশে টাকা আসার খবর প্রতারকদের কাছে কীভাবে পৌঁছে? এই চক্রের সঙ্গে স্থানীয় কেউ জড়িত নেই তো? এর প্রতিকার ও তদন্ত দাবি করে তারা।

কাশিনাথপুর ফুলবাড়ি মোড়ের বিকাশ এজেন্ট মোহন হক জানান, উপবৃত্তির টাকা ছাড় হওয়ার পর থেকেই শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে প্রতারক চক্র। প্রতিদিনই তাঁদের কাছে শিক্ষার্থীরা টাকা খোঁয়া যাওয়ার অভিযোগ নিয়ে আসছে। তাঁরা শিক্ষার্থীদেরকে কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগের পরামর্শ দিচ্ছেন।

বিকাশ কাস্টমার কেয়ারের কাশিনাথপুর শাখার ইনচার্জ মো. অপু হোসেন বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে আমাদের এখানে এ ধরনের অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগ আমরা লিখে রাখছি। কিন্তু আমাদের করণীয় কী আছে? গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন বা অন্যান্য ক্ষেত্রে পিন নম্বর সংরক্ষণে নিজেদের মধ্যে সতর্ক থাকা দরকার।’

হাটুরিয়া-নাকালিয়া প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক শামিম আহমেদ বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আলোচনা করতে শুনেছি, শিক্ষকদের সাথে কথা বলেও জেনেছি। আমার কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রাথমিকের বৃত্তির টাকা আসার কথা আছে। আমি আগেই তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছি।

নাকালিয়া সাঁড়াশিয়া বণিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত ওসমান বলেন, প্রতারকদের ফোন পেয়ে কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষার্থী আমার কাছে এসেছিল অভিযোগ নিয়ে। আমি তাঁদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছি।’ বাড়িতে বাড়িতে শিক্ষক পাঠিয়ে সতর্ক করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতেছি।

বেড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খবির উদ্দিন বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী যাতে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা না দেয় সে ব্যাপারে আমরা সকল স্কুলের শিক্ষকদেরকে মেসেজ দিচ্ছি। শিক্ষকেরা দ্রুত এ বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেবেন।

আমিনপুর পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রওশন আলী বলেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেনি। আসলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

বিষয়ে বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সবুর আলী জানান, এ বিষয়ে আমি কোন অভিযোগ পাইনি। তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে মামলা করে ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানান তিনি। বিকাশ ও নগদ পিন আদান প্রদানে সবাইকে সতর্ক হওয়ার কথা বলেন তিনি।

পাবনায় শিক্ষার্থীদের নগদ ও বিকাশে পাঠানো উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র
Comments (0)
Add Comment