তৌহিদ উদ দৌলা রেজা: সব্বোর্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে সকল তামাকপণ্যের মোড়কের উপরিভাগে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করা জরুরি। পাশাপাশি বিদ্যমান সচিত্র বার্তাগুলোর ছবি ও বার্তা পরিবর্তন করা প্রয়োজন, যাতে করে মানুষ সহজেই সচেতন হতে পারে। একই সাথে চর্বণযোগ্য তামাকের বাজার ব্যবস্থার উপর নজরদারি করা উচিৎ যেন সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর আদায়ের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি করা যায়।
মঙ্গলবার (১০আগস্ট)সকাল ১১.০০ মিনিটে টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি), ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভির্সিটি, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাষ্ট, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি) এবং বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট (বাটা)-এর আয়োজনে ‘আইন অনুযায়ী তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়ন- বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক গবেষণার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
টিসিআরসির প্রেসিডেন্ট ও মাননীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপির সভাপত্বিতে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের উপদেষ্টা ও নাটাব-এর প্রেসিডেন্ট মোজাফফর হোসেন পল্টু। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খন্দকার, সিএলপিএর রিসার্চ কনসালটেন্ট ও ঢাকা ডেন্টাল কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ আ ফ ম সারোয়ার, বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের সমন্বয়কারী সাইফুদ্দিন আহমেদ এবং দ্য ইউনিয়ন কারিগরী পরামর্শক এ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেলের সহকারী গবেষক ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা জামান লিজা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো প্রোগ্রাম ম্যানেজার (তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প) হামিদুল ইসলাম হিল্লোলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ও টিসিআরসির সদস্য সচিব মোঃ বজলুর রহমান।
মূল প্রবন্ধে ফারহানা জামান লিজা বলেন, এ গবেষণায় দেশের ১৬টি জেলা ও ১৬টি উপজেলা হতে মোট ৯৫১ টি তামাকপণ্য সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, ৭৯% তামাকপণ্যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ হলেও তাতে অনেক ফাঁক ছিল। আইন অনুযায়ী মোড়কের ৫০ শতাংশ এলাকা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য বার্তা প্রদানের হার মাত্র ৬৯%। মোড়কের উভয় দিকে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর মুদ্রণের হার ৪৪% এবং ১৭% মোড়কে নিদির্ষ্ট মেয়াদের ছবি পরিলক্ষিত হয়নি।
এছাড়া কোন সিগারেটের কার্টনেই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী পাওয়া যায়নি। ৯০% মোড়কের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ব্যান্ডরোল দিয়ে ঢেকে থাকতে দেখা গেছে, ৪৯% মোড়কেই “শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিক্রয়ের জন্য অনুমোদিত” মর্মে কোন বাণী প্রদান করা হয়নি। আইনের ১০ ধারার সব উপধারা মেনে সচিত্র সতর্কবাণী প্রদানের হার মাত্র ১% শতাংশের কম। কোভিড-১৯ সময়কালে তামাক কোম্পানিগুলো আরো বেশি আইন লঙ্ঘন করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, আইনে উপরের দিকে ছবি মুদ্রণের কথা থাকলেও ৮২% মোড়কেরই নিচের দিকে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রিত হয়েছে।
মূল প্রবন্ধে আইন বাস্তবায়নে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন তিনি। আপিল ডিভিশনের রিট পিটিশন নং ১১৭৮৫ (২০১৬) এর রায় (তারিখ ৬ ডিসেম্বর ২০২০) অনুযায়ী তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মোড়কের উপরের দিকে মুদ্রণ করার উপর জোর দেন তিনি। এছাড়াও স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং প্রবর্তন, খুচরা শলাকা ও পানের সাথে জর্দ্দা বিক্রয় বন্ধসহ, খোলা তামাক ও সাদা পাতাকে মোড়কের আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও মোবাইল কোর্টের সংখ্যা বৃদ্ধি করা ও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীবিহীন তামাকপণ্য ধ্বংস করা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ জানান তিনি।
ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, তামাকজাত পণ্যের মোড়কে ৯০ শতাংশ ক্ষতিকর ছবি যুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। তামাকমুক্ত দেশ গড়তে সরকারি কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে ট্যাক্স বাড়াতে হবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তগুলো আসছে মন্থর গতিতে। তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রোগী বাড়বে। এভাবে রোগী বাড়লে ভবিষতে চিকিৎসা দিতে পারব না। এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ত সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদসহ সকল স্তরের মানুষের। এজন্য একটা গাইড লাইন দরকার। দীর্ঘ মেয়াদী পলিসি নিতে হবে।
মোজাফফর হোসেন পল্টু বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত করবেন। সরকার প্রধানের এই ঘোষনা বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রাখবে সরকারি কর্মকর্তাগণ। তামক নিয়ন্ত্রণে আইন বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। তিনি বলেন, আমরা ভয়েলেন্টিয়ার হিসাবে কাজ করে এতোদিন গুছিয়ে আনার পর এখন দেখছি পথে ঘাটে উন্মুক্ত ধূমপানের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এর বড় কারন আইনে প্রয়োগ নেই।
হোসেন আলী খন্দকার বলেন, ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই ঘোষনা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। তবে অনেক প্রতিবন্ধকতাও আছে যার ফলে অনেক সময় কাজের গতিটা কমে যায়। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করেই আমরা প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য পূরণে কাজ করব।
আ ফ ম সারোয়ার বলেন, আইনের বাস্তবায়ন কেন সম্ভব হচ্ছেনা সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। আইনে তামাকপণ্যের কার্টনেও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের কথা উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও কোন কার্টনে তা পরিলক্ষিত হয়নি। আইন অমান্যকারীদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, তামাকপণ্যের মোড়কে ৯০% সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ এখন সময়ের দাবি। স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং প্রবর্তন সম্ভব হলে এটি খুব সহজেই করা যাবে। পাশাপাশি বিদ্যমান ছবিগুলো পরিবর্তনের অত্যন্ত জরুরি।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, টিসিআরসি দীর্ঘদিন ধরে শুধু মনিটরিং-এর কাজই করছে না বরং প্রশাসনকে আইন প্রয়োগেও সহায়তা করে। পাশাপাশি ক্যাপাসিটি বিল্ডিং-এ টিসিআরসির ভূমিকা লক্ষ্যণীয়। টিসিআরসির গবেষণা অনুযায়ী বিড়ি ও জর্দা-গুলের উৎপাদন ইনফরমাল হলেও মার্কেটিং খুবই ফরমাল। খোলা তামাক ও সাদা পাতাকে মোড়কের আওতায় আনা ও সকল তামাকপণ্যের বাজার মনিটরিং অত্যন্ত জরুরি। উক্ত ওয়েবিনারে সারাদেশের সরকারী -বেসরকারী ও আর্ন্তজাতিক সংস্থার প্রতিনিধি ও স্থানীয় পর্যায়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ ও অংশগ্রহণ করেন।