ইউসুফ আলী মন্ডল নকলা শেরপুর প্রতিনিধি : দেশে অনেক জাতের লেবু চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে কাগজি লেবু, পাতি লেবু, এলাচি লেবু, বাতাবি লেবু ও হাইব্রিড নতুন জাতের সিডলেস (বীজহীন) লেবু উল্লেখযোগ্য। তবে ফলন ও দাম বিবেচনায় শেরপুর জেলার নকলা উপজেলায় সিডলেস লেবুর আবাদ দিন দিন ব্যাপকহারে বাড়ছে।লেবুতে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষক অন্য আবাদ ছেড়ে এ লেবু চাষে ঝুঁকছেন। সিডলেস লেবু চাষে এক বছরের আয় দিয়েই ব্যয় উঠে যাওয়ায়, দ্বিতীয় বছর থেকে লাভের পরিমাণ বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় বছরে লাভের টাকা গুনছেন এমন একজন লেবু চাষী হলেন নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের বাছুরআলগা উত্তর পাড়া গ্রামের মো. আবু রায়হান শামীম। সে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ৪ একর জমি লিজ নিয়ে সেখানে সিডলেস লেবু চাষ শুরু করেন। জমি বন্ধক, কলম কাটা চারা কিনা, জমি তৈরী, শ্রমিকের মজুরিসহ প্রথম বছর তার খরচ হয় ১০ লাখ টাকা। এক বছর যেতে না যেতেই ফলন আসা শুরু হয়। প্রথম বছরেই তার খরচ উঠে যাওয়ায় এখন শুরু হয়েছে লাভের পালা।
শামীম জানান, সে ১০ বছরের জন্য প্রতি একর জমি বছরে ৩০ হাজার টাকা হারে লিজ নিয়েছেন। এতে প্রথম বছর ৪ একর জমি বন্ধক বাবদ এক লাখ ২০ হাজার টাকা, প্রতিটি ২২ টাকা করে কলম কাটা ২ হাজার চারা ক্রয় করাসহ জমি তৈরী, রোপন, সেচ, সার, বেড়া দেওয়া ও শ্রমিকের মজুরি মিলে প্রায় ১০ লাখ টাকা তার ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে ৮০ ভাগ গাছে ফলন আসায় সে প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ টাকার লেবু বিক্রি করতে পারছেন। তার লেবু বাগানের জন্য ৩ জন লেবু উঠানোর শ্রমিক ও ২ জন শ্রমিককে মাসিক বেতন হিসেবে স্থায়ী ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। এতে করে স্থানীয় ৫ থেকে ৮টি পরিবার আয়ের পথ খোঁজে পেয়েছেন।
তিনি জানান, চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের উত্তর বাছুরআলগা গ্রামের আবদুল হাসেম, লুৎফর রহমান ও তার ছোট ভাই মোস্তাক আহমেদসহ উপজেলার অনেকেই এখন লেবু চাষে ঝুঁকছেন। শামীম বলেন, এ বছর লেবুর দাম ভালো থাকায় বেশ লাভে লেবু বিক্রি হচ্ছে। তিনি বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার লেবু বিক্রি করছেন। সরেজমিনে উপজলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর ধরে উজেলার বানেশ্বরদী, পাঠাকাটা, টালকী, চরঅষ্টধর, উরফা, গনপদ্দী, গৌড়দ্বার ও চন্দ্রকোনা ইউনিয়ন এবং নকলা পৌর সভার বিভিন্ন এলাকার উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে বেলে-দোআঁশ মাটিতে লেবু চাষ করে কৃষকরা আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন। খরচের তুলনায় কয়েক গুণ লাভ পাওয়ায় এ ফসল চাষে কৃষকদের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। ফলে উপজেলা জুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য লেবুর বাগান। তাছাড়া উপজেলার প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় ২/৩ টি করে লেবুর চারা রোপন করেছেন কৃষকরা। এতেকরে নিজেদের চাহিদা অনায়াশে মিটে যাচ্ছে। আর বাগানে উৎপাদিক লেবু স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলা-উপজেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রায় প্রতিটি বাগান মালিক নিজের বাগানের গাছে কলম দিয়ে থাকেন। তাদের উৎপাদিত কলম চারা দিয়ে ফি-বছর নতুন বাগান তৈরি করা ছাড়াও প্রতিটি কলম করা চারা ২৫ টাকা থেকে ৩৫ টাকা করে বিক্রি করেন।
লেবু চাষিরা জানান, লেবুর বাগান সাধারণত বাড়ির আশেপাশে থাকায় বাগান পরিচর্যায় স্ত্রী ও সন্তানরা সহযোগিতা করার সুযোগ পায়, ফলে শ্রমিক ব্যয় কম হয়। তারা জানান, লেবু বাগানের আয় দিয়েই তাদের সংসারের সব খরচ চলে। তারা প্রত্যেকেই আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন। রোপণের বছর বাদে প্রতি বছর একবার ডালপালা ছাটাই, মাটি কোপানো, প্রতি ৩ মাসে একবার নিড়ানি ও ২ থেকে ৩ মাস অন্তর সেচ ও সামান্য জৈব সার ব্যবহার ছাড়া আর কোন খরচ হয়না।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস জানান, উপজেলায় অন্তত ৩০ হেক্টর (৮৫ একর থেকে ৯০ একর) জমিতে লেবু চাষ করা হয়েছে। তিনি বলেন, সারা বছর ফলন দেওয়া অধিক ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ প্রচুর রস ও সু-ঘ্রণযুক্ত হাইব্রিড জাতের এ বীজ বিহীন (সিডলেস) লেবুর ব্যাপক চাহিদা থাকায় ও দাম ভালো পাওয়ায় লেবু চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। সঠিক সময়ে সঠিকভাবে লেবু বাগানের বা গাছের পরিচর্যা করলে একবার চারা রোপণের পর ১৫ বছর থেকে ২০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস আরও বলেন, লেবু বাগান মালিকদের কৃষি বিভাগ থেকে সার্বক্ষণিক পরার্মশ সেবা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি উপজেলায় লেবু জাতীয় ফসলের আবাদ বৃদ্ধির লক্ষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে চাষীদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। লেবুচাষ লাভজনক হওয়ায় এরই মধ্যে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বেশ কিছু বাগান গড়ে উঠেছে। অধিক লাভজনক এ লেবু বাড়ির আঙ্গিনাসহ পতিত জমিতে বানিজ্যিক ভাবে চাষ করে যে কেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে তিনি মনে করেন।