ইয়াছিন আরাফাত কক্সবাজার : দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের সোনাপাড়া-চিকনি পাড়া এসপিএম প্রকল্পের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের কাছে পৌঁছেনি ক্ষতিপূরণের তিনগুণ টাকা। ফলে চরম সংকটে পড়েছেন কয়েকটি পরিবারের মানুষ। ঘরে তিন বেলা খাবার যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকেই। প্রকল্প এলাকার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম সোনাপাড়া ঘুরে এ বিষয়ে নানা তথ্য জানা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সোনাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোছাইনের স্ত্রী সেতারা বেগম বলেন, এসপিএম প্রকল্প সড়কের কারণে তার দোকান ও মাথা গোজার বসত ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে জেলা ভূমি অধিকগ্রহণ শাখা থেকে নোটিশ ও ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু অধিকগ্রহনের তিন গুণ ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও উক্ত সেতারা বেগমের নোটিশে উল্লেখ্য দুই গুণ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত সেতারা বেগম নোটিশ গ্রহণ করার পর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পাশ্ববর্তী কয়েকটি পরিবার ক্ষতিপূরণের নোটিশ পেয়েছে তিনগুণ টাকা পেয়ে উচ্ছেদ হয়েছে। কিন্তু সেতারা বেগম নোটিশ গ্রহণ করলে তিনগুণ টাকা না পাওয়ায় উক্ত টাকা উত্তোলন করতে যাবেনা। তিনি আরও বলেন, তিন গুণ টাকা না পাওয়া পর্যন্ত ঘর ও দোকান উচ্ছেদ করতে দেবেন না।
তিনি তিনগুণ টাকাসহ পূর্ণবাসনের দাবি জানিয়ে বলেন উচ্ছেদ হওয়া অনেকে পেয়েছে দুই গুণ টাকা আবার অনেক তিন গুণ তবে কেন। তিনি একটি দালাল সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এসব দুর্নীতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। তবে ঐ দালাল সিন্ডিকেটটি এসব অসহায় সেতারা বেগমের মত অনেক পরিবারকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন মুখ না খুলতে। সরকারি নথি অনুসারে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের অধীনে বাস্তবায়নাধীন সিঙ্গেল মুরিং পয়েন্ট প্রকল্পের জন্য মহেশখালী কালারমারছড়া ইউনিয়নের সোনাপাড়া গ্রামে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। জানাগেছে, ৪০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। যার ফলে অন্তত ৪০০ দরিদ্র পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। প্রভাবশালীরা বুলডোজার দিয়ে ঘর বাড়ী উচ্ছেদ করতে ভূমিকা পালন করেছেন। এই জমির আনুমানিক বাজারমূল্য ১৪ কোটি টাকা এবং জমি অধিগ্রহণ মূল্য ৪২ কোটি টাকা। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন- ২০১৭ এর অধীনে সরকার জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জমির বাজারমূল্যের তিনগুণ দাম প্রদান করার কথা রয়েছে। কালারমারছড়ার সোনাপাড়ার মতো কক্সবাজারের আরও ২০টি বড় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জেলা ভূমি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা জোটবদ্ধভাবে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে নিচ্ছে। জমি অধিগ্রহণে অনিয়মের প্রতিবাদে গঠিত ‘জাগ্রত ছাত্রসমাজ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ফজলে আজিম মোঃ ছিবগাতুল্লাহ জানান, স্থানিয় একটি দালাল সিন্ডিকেট তাদের বাধ্য করেছে কম দামে জমি বিক্রি করতে। ফজলে আজিম মোঃ ছিবগাতুল্লাহ বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় জনগণের হয়রানি ও ভোগান্তির দিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমরা অনেকবার বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছি। প্রতিকার পাওয়ার বদলে আমরা পেয়েছি প্রভাবশালীদের হুমকি। উচ্ছেদের শিকার হওয়া অনেকে মানুষগুলো এ ঘটনায় জড়িত প্রভাবশালীদের নাম বলতেও ভয় পেতেন। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি তদন্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি প্রকাশ পেয়েছে বলে জানান তিনি। অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য সরকারি দপ্তরে ফাইল জমা দেওয়ার পর ‘কমিশন’ দাবির মধ্য দিয়ে আরেক দুর্নীতি শুরু হয়। ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হারে ‘কমিশন’ না দিলে ফাইল নড়ে না। প্রকৃত জমির মালিকেরা সব কাগজ যথাযথভাবে দিয়েও টাকা পাননি। অন্যরা বললেন, দেশের স্বার্থে মহেশখালীতে উন্নয়নের মেগাপ্রকল্পের জন্য, নালজমি, কৃষিজমি, ভিটেমাটি পর্যন্ত চিরতরে ছেড়ে দিয়েছি। তার বিনিময়ে আমরা কী পাচ্ছি? জমিজমার ন্যায্য মূল্যও বুঝে পাচ্ছি না। উল্টো দালালকে ঘুষ ও কমিশনের টাকা আগে গছিয়ে দিতে হচ্ছে। ঘুষের ভাগ নাকি কতিপয় জনপ্রতিনিধিসহ উপরের দিকে চলে যায়। দৈনিক কোটি টাকা হাতবদল। এতে কাজ করেছেন উপজেলার কালারমারছড়া ভিত্তিক দালাল চক্রের সিন্ডিকেট। এছাড়াওভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে একটি ‘কুচক্রী মহল’ প্রায় ২২ কোটি টাকা লোপাট করেছে উক্ত প্রকল্পে থেকে। কালারমারছড়ার সোনা পাড়া-চিকনি পাড়া থেকে এস পি এম প্রকল্পের পাহাড়ি জমি ধান্য জমি অধিকগ্রহণ করে। যার এলএ শাখার মামলা নং- ০৮/২০১৭-২০১৮। অধিকগ্রহণকৃত জমির অবকাঠামো স্থাপনার জন্য বরাদ্দ পায় ২২ কোটি টাকা। এ বরাদ্দকৃত টাকা পেতে ২২ ধারা নোটিশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা অন্যান্য নোটিশ পেলেও অনেকে ২২ ধারা নোটিশ পাননি। অভিযোগ উঠেছে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের নোটিশ গোপন করে ভূঁয়া অবকাঠামো দেখিয়ে টাকা উত্তোলন, ভূঁয়া পরিচয় পত্র সৃজন, নামে-বেনামে মালিক দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করায় ক্ষতিগ্রস্তরা এলাকায় মানববন্ধনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিক অভিযোগ হয়েছে।
২২ ধারা নোটিশ গোপন ও ভূঁয়া কাগজে দস্তগত সই করার জন্য এলাকার জনপ্রতিনিধিকে দায়ি করেছেন ভোক্তভোগি ক্ষতিগ্রস্তরা।
চট্টগ্রাম দুদক কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘জেলার রাঘব বোয়ালদের সমন্বয়ে এটি একটি বিরাট জোট। তারা জমি অধিগ্রহণের পুরো প্রক্রিয়ায় সবাইকে জিম্মি করে রেখেছে। আমরা এই জোটকে চিহ্নিত করেছি এবং এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছি। অবশ্যই আইন অনুযায়ী আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসিল্যান্ড সুইচিং মংম মারমা বলেন, জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিকগ্রহণ শাখা থেকে ক্ষতিপূরর্ণের কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে। তিনগুণ ক্ষতিপূরণের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভাল জানবেন। আর উপজেলা ভূমি অফিসের পক্ষ থেকে জমি অধিকগ্রহণের শুরু থেকে জমির পরিমাপের বিষয়টির কাজ ছিল মাত্র ।