মাহফুজ আলম, স্টাফ রিপোর্টার : পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের মধ্যে মারমাদের প্রধান সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই। নতুন বর্ষ বরণের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মারমা পাড়াতে বইছে জল উৎসবের জোয়ার। করোনার কারণে গত দুই বছর জলোৎসব না হওয়ায় এবছর ২০২২ এ যেন উৎসবে মাতোয়ারা হয় উঠেছে পাহাড়ের মানুষ। আর মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাই জল উৎসবের আয়োজনের মধ্যদিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু শেষ হচ্ছে। তবে মারমাদের পানি খেলা মধ্য দিয়ে বৈসাবী উৎসব শেষ হয়ে গেলেও এর রেশ থেকে যায় প্রায় পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে।
রাঙামাটিতে উৎসবের শেষ দিনে মারমা সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা একে অপরকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে পুরনো বছরের সব দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি ধুয়ে-মুছে দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে সাংগ্রাই জল উৎসবে মেতে ওঠেন। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ সমবেত হয়েছে।শনিবার (১৬ এপ্রিল) সকালে রাঙামাটিতে কেন্দ্রীয় ভাবে মারমা সংস্কৃতি সংস্থা (মাসস) আয়োজনে ‘পার্বত্য অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সংস্কৃতি বিকাশে এগিয়ে আসুন’ এই শ্লোগানে রাঙামাটির কাউখালী বেতবুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পিতলের ধর্মীয় ঘণ্টা বাঁজিয়ে উৎসবে পানি খেলার সূচনা করেন, রাঙামাটির সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি।
এরপর প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথিরা ফিতা কেটে জলকেলির উদ্বোধনের পর অতিথিরা মারমা যুবক যুবতিদের গায়ে পানি ছিটিয়ে জলকেলির শুভ সূচনা করেন। জলকেলির পর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মারমা শিল্পিদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও মারমা সাংস্কৃতিক সংস্থার (মাসস) সভাপতি অংসুই প্রু চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ উৎসবে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তারিকুল ইসলাম, রাঙামাটি জোন কমান্ডার বিএম আশিকুর রহমান, রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আশরাফুল ইসলাম, রাঙামাটি পুলিশ সুপার মীর মোদদাছছের হোসেন, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান চিংকিউ রোয়াজা প্রমুখ।
এ উৎসবে হাজার হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নরনারী ছাড়া ও কয়েক হাজার বাঙ্গালী নরনারী উপস্থিত থেকে এ উৎসবে অংশ গ্রহণ করেন। পাহাড়ী-বাঙ্গালীর পদধুলীতে এক মহামিলন মেলায় পরিণত হয় মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই বা জল উৎসবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাঙামাটির সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, সাংগ্রাই উৎসব শুধু মারমা সম্প্রদায়ের নয়। এ উৎসব পাহাড়ে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এটাই হলো বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার রূপ। আর এই ধরনের অনুষ্ঠান পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে ভ্রার্তৃত্বের সর্ম্পককে আরো সুদৃঢ় করে তুলবে। এখন সময় এসেছে তা সকলের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার।
তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে বসবাসরত মুসলমান, হিন্দু, চাকমা, মারমাসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে সকল জাতি সত্তা রয়েছে তারা সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক এক কথায় আমরা সবাই বাংলাদেশি। আমাদের মাঝে কোন ভেদাভেদ নাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ভাষাভাষি, সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাই এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ আর্থ সামাজিক উন্নয়নে যা যা করা প্রয়োজন তা করতে বর্তমান সরকার সব ধরণের সহযোগীতা করে যাচ্ছে। যার যার যে ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে আমাদেরকে সেগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। পুরাতন বছরের সকল গ্লানি মুছে ফেলে নতুন বছরের শুভ কামনার জন্য বৃহত্তম এ আয়োজন করা হয়।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও মারমা সাংস্কৃতিক সংস্থার (মাসস) সভাপতি অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, সবার কাছে প্রত্যাশা করছি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্প্রীতি পার্বত্য চট্টগ্রামে অটুট থাকুক এবং এই সম্প্রীতির মাধ্যমে পাহাড়ে যে হানাহানি-মারমারি, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি হচ্ছে সেটা বন্ধের মাধ্যমে পাহাড়ে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করুক। আর সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যবোধ ও স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে প্রত্যাশা আছে শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন। পাহাড়ে স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হলে শান্তিচুক্তি যেসব অবাস্তবায়িত আছে সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ও সম্প্রীতি ফিরে আসুক।