সাতক্ষীরার কলারোয়ার বাউলকন্যা আসমা আক্তার এখন ম্যাজিস্ট্রেট

রিজাউল করিম, সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি: ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার আসমা আক্তার মিতা। অভাবী বাবা লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করতে না পারলেও থেমে যাননি আসমা । টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন। দীর্ঘ পরিশ্রমের ফল পেয়ে পরিবারে এখন বইছে আনন্দের বন্যা। এলাকার মানুষ আসমাকে দেখতে ভিড় করছেন প্রতিদিন তার বাড়িতে।
আসমা আক্তার মিতা সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কেরালকাতা ইউনিয়নের কিসমত ইলিশপুর গ্রামের সাধক মোতাহার হোসেন মন্ডলের মেয়ে। এক ছেলে ও তিন মেয়ে তার।

বড় ছেলে ফয়সাল হোসেন রিকো বাসের স্টার্টারের কাজ করেন। বড় মেয়ে রেশমা আক্তার লতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করেছেন। মেজ মেয়ে আসমা আক্তার মিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে এখন বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। ছোট মেয়ে শামীমা আক্তার নিপা দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে।

আসমা ২০১০ সালে কেকেইপি সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান। কলারোয়া কাজীর হাট কলেজ থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে ২০১২ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞান বিভাগে সিজিপিএ-৩.৫৯ পেয়ে অনার্স ও একই বিষয়ে সিজিপিএ-৩.৬০ পেয়ে মাস্টার্স উত্তীর্ণ হয়। বর্তমানে ৪০তম বিসিএস প্রশাসন বিভাগে মেধাক্রমে ৬০ পেয়ে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
আসমার মা ঝর্ণা খাতুন বলেন, তার ছোটবেলা থেকে আমরা ঠিকমতো খরচ দিতে পারিনি। নতুন জামা-কাপড়ও দিতে পারিনি তাকে। খুব কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছে আসমা। এখন ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে। খুব ভালো লাগছে বলেই আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি।

প্রতিবেশী রুমা খাতুন বলেন, আসমা আমাদের সামনে বড় হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই সে খুব মেধাবী ছিল। তার এমন সফলতায় এলাকার মানুষ এখন গর্বিত। আসমা আক্তারের বাবা সাধক মোতাহার হোসেন বলেন, আমার পরিবারের অন্যরা আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকলেও আমি গরিব মানুষ। আধ্যাত্মিক জগতের সাধনা করি, গান লিখি, গবেষণা করি। দুনিয়ার অর্থ-সম্পদের প্রতি কখনো আমার লোভ ছিল না, এখনো নেই। আমার বাবাও ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক।

অভাবের মধ্যেই মেয়ে পড়াশোনা করেছে। এখন ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে, এটা আল্লাহর দান। আমি যেভাবে সারা জীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছি, ঠিক তেমনিভাবে যেন আসমাও তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে, সে জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করছি।
তিনি আরও বলেন, মেয়েটার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেত। তবে বিভিন্ন সময় ভালো ফল করার কারণে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা পাওয়ায় সেসব টাকা দিয়েই লেখাপড়া করেছে। নিজে টিউশনিও করেছে। কষ্টের দিনগুলো তার এখন শেষ হয়েছে, আমারও স্বপ্নপূরণ হয়েছে।

দীর্ঘ কষ্টের পথ অতিক্রমের সেই অনুভূতি জানাতে গিয়ে অনেকটা অপ্লুত হয়ে পড়েন আসমা। তিনি বলেন, আমার বাবা বাউল সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদের অর্থ ছিল না কিন্তু ইচ্ছা ছিল। আমরা চাইতাম আমাদের পথ যেন কেউ তৈরি করে না দেয়, আমাদের পথ আমরা নিজেরাই তৈরি করব। আব্বুর সচ্ছলতা না থাকলেও এসএসসি ভালো রেজাল্ট করায় বৃত্তি পেয়েছি সেটা দিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক থেকে বৃত্তি পেয়েছিলাম। এই বৃত্তির মাধ্যমে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছি।

তিনি আরও বলেন, আমি সব সময় চাইতাম মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাব। একটা সরকারি চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন ছিল। ভালো পোশাক, খাওয়াদাওয়া— এসব আশা করিনি কোনো দিন। আমার টিউশনির টাকা দিয়ে বই কিনেছি। দিনে ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা লেখাপড়া করেছি। আজ সাফল্যের চ’ড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছি। দায়িত্ব পালনকালে সব সময় আমি সঠিক কাজটি করব।

সাতক্ষীরার কলারোয়ার বাউলকন্যা আসমা আক্তার এখন ম্যাজিস্ট্রেট
Comments (0)
Add Comment