নিজস্ব প্রতিনিধি : পাবনা-২ (সুজানগর-বেড়ার আংশিক) নির্বাচনী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কেন্দ্রিক গ্রুপিং চলে আসছে। দলীয় ও ক্ষমতার প্রভাব এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই গ্রুপের কর্মকান্ড মাঝে মধ্যেই প্রকাশ্য রূপ লাভ করে।
সম্প্রতি একটি অংশের নেতারা মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠানে আগামী নির্বাচনে পাবনা-২ আসনের প্রার্থী হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান উজ্জ¦লকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। যা নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগে একটি বড় অংশ রয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীনুজ্জামান শাহীনের অনুসারী। অন্যদিকে সুজানগর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুল ওহাব নেতৃত্ব দিচ্ছেন আরেকটি অংশের।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওহাবের ছায়া হয়ে হয়ে রয়েছেন সদ্য ঘোষিত জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান উজ্জ¦ল। তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। এ আসনের বেড়ার আংশিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও সদ্য ঘোষিত আমিনপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক বাবু।
এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পাবনা-২ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবিরের অনুসারী হিসেবে তার কমর্কান্ডের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীনুজ্জামান শাহীনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য আহমেদ তফিজ উদ্দিনের পুত্র বর্তমান সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির তার নির্বাচনী এলাকায় সকল কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোন গ্রুপের অনুসারী না হয়ে নির্বাচনী এলাকার মানুষের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে এলাকার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন।
জানা যায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন, বর্তমান সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির, সাবেক সংসদ সদস্য আজিজুল হক আরজু, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও কৃষকলীগের সাবেক সভাপতি ড. মির্জা জলিল, রাকসুর সাবেক জিএস ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য খন্দকার জাহাঙ্গীর কবির রানা, ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. সাঈদুর রহমান ও সদ্য ঘোষিত জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান উজ্জ¦ল।
গত শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) পাবনার আমিনপুর থানা আওয়ামী লীগ কাশিনাথপুর ডাকবাংলোতে দুপুরে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। ওই মতবিনিময় সভায় থানার ৮ ইউনিয়নের সভাপতি-সম্পাদক, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সভাপতি-সম্পাদকসহ দলীয় অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময় সভায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে পাবনা-২ আসনে কামরুজ্জামান উজ্জ¦লকে দলীয় সমর্থন দিয়ে নির্বাচন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন নেতাকর্মিসহ জনপ্রতিনিধিরা।
ওই মতবিনিময় সভায় কামরুজ্জামান উজ্জ্বল ছিলেন প্রধান অতিথি। বিশেষ অতিথি ছিলেন সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুল ওহাব এবং বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও আমিনপুর থানা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক রেজাউল হক বাবু। এ সময় সুজানগর পৌরসভার সাবেক মেয়র তোফাজ্জল হোসেন তোফাসহ আমিনপুর থানার ৮ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা উপস্থিত ছিলেন।
কাশিনাথপুর ডাক বাংলোতে আমিনপুর থানা আওয়ামী লীগের একাংশের এই মতবিনিময় সভাকে দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুন্নসহ চক্রান্তমূলক সভা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন পাবনা-২ আসনের আওয়ামী লীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তাদের প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় কোন সিদ্ধান্ত, জেলার কোন সিন্ধান্ত ছাড়া কিভাবে একটি অংশ রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত করতে এ ধরণের হটকারি কাজ করতে পারে। একটি থানা কমিটির এক অংশ একক প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সংসদীয় আসনের নির্বাচনী এলাকায় এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলছে নেতাকর্মিদের মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণসহ নানা আলোচনা আর সমালোচনা ঝড়।
পাবনা-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক সচির ড. মজিবুর রহমান বলেন, এ কাজ করে নিছক একটি ছেলে মানুষির পরিচয় দেয়া ছাড়া আর কি বলা যায়। আমি আমিনপুর থানা আওয়ামী লীগের একটি অংশের আয়োজিত মতবিনিময় সভা ও তাদের প্রার্থী সিলেকশনের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছি।
জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার আজিজুল হক আরজু বিষ্ময় প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠন। কে কি সিন্ধান্ত নিলো সেটা বড় বিষয় নয়। দলীয় প্রধান যাকে মনোনয়ন দেবেন তিনিই প্রার্থী হবেন। যারাই বুঝে হোক আর না বুঝে হোক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটা মোটেও কাম্য হতে পারে না।
এ বিষয়ে আমিনপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউসুফ খান বলেন, আমাকে না জানিয়ে এই মিটিং করা হয়েছে। যা নিয়ম বর্হিভূত ও সাংগঠনিক বিধিসম্মত নয়। সাধারণ সম্পাদক পক্ষপাত ও গ্রুপিং করে আমিনপুর থানা আওয়ামী লীগের মধ্যে মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। তিনি স্থানীয় এমপিকে কোন প্রোগ্রামে ডাকেন না। উল্টো পাশের উপজেলা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকে নিয়ে এসে মাতুব্বারী করান। আমি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও আমিনপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক বাবু বলেন, ওই সভায় তো কাউকে মনোনয়ন দেয়া বা প্রার্থী ঠিক করা হয়নি। এটাতো আমরা ইচ্ছা করলেই পারি না। স্থানীয় আওয়ামী লীগ কখনো প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারে না। আমরা মুলত আমাদের সমর্থক নেতাদের নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে কামরুজ্জামান উজ্জ্বলকে সমর্থন করেছি। বলেছি আপনি যদি মনোনয়ন আনতে পারেন আমরা আপনার সাথে কাজ করবো। আর থানা আওয়ামীলীগের সভাপতিকে জানালেও তিনি আসতেন না। কারণ তিনি বর্তমান এমপির সমর্থক।
সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র আলহাজ্ব আব্দুল ওহাব বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য দলীয় কোন কর্মসূচী পালন করেন না। তিনি আওয়ামী লীগের সাথেই নেই। তিনি নিজের মনমতো যা ইচ্ছে তাই করেন। তার কর্মকান্ডে কোন দলীয় নেতাকর্মিদের সম্পৃক্ত না করে নিজের অনুসারী লোকজন নিয়ে কাজ করেন। সংগঠন ঠিক রাখার জন্য আমাকে কেউ ডাকলে তাদের ফেরাতে পারিনা। যে কারণে আমিনপুর থানা আওয়ামী লীগের ওই মিটিংয়ে যোগ দিয়েছি।
সভাপতি ছাড়া মিটিং এবং একাংশের সিদ্ধান্তে প্রার্থী ঘোষণা দেয়া যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেহেতু এমপি সাহেব আমাদের ডাকেন না। দলের কোনো কাজ করেন না। তাই আমরা আমাদের পছন্দমতো একজনকে খুঁজে নিয়ে সমর্থন দিয়েছি।
সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীনুজ্জামান শাহীন বলেন, আমি পত্রিকায় সংবাদটি দেখেছি। সভাপতিকে বাদ রেখে একটা থানা আওয়ামীলীগের সভা কিভাবে হয়। আর সেখানে একজন প্রার্থীকে কিভাবে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয় বুঝলাম না। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কি কোনো থানা আওয়ামী লীগের কেউ দিতে পারে? আসলে বিএনপি-জামায়াত থেকে হাইব্রিড কিছু নেতা এসে দলের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিভেদ সৃষ্টি করছে।
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক কামরুজ্জামান উজ্জ¦ল বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য নেতাকর্মি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেছেন। নেতাকর্মিদের বাদ দিয়ে নিজের মতো করে ইচ্ছে মাফিক কাজ করছেন। ফলে নেতাকর্মিরা একটি দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব খুজছেন। হয়তো তাদের কাছে আমি সেই যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছি আমার কর্মকান্ড দিয়ে। সেই জন্যই তারা আমাকে আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থীর সমর্থন দিয়েছেন। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে অবশ্যই আমি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে এলাকার মানুষের খেদমত করতে পারবো।
পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির বলেন, এটা অগণতান্ত্রিক ও অসাংগঠনিক কাজ। এটি তাদের রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব ও হীনমন্যতার প্রকাশ। এভাবে কখনো একজন প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া যায় না। যদি তাই হতো, তাহলে তা মনোনয়ন বোর্ডের দরকার ছিল না। দলের সভানেত্রীর সিদ্ধান্তের দরকার ছিল না। একটা থানা আওয়ামী লীগ থেকে একজনকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হলো অথচ সেখানে সেই থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি জানেন না।
তিনি কোন দলীয় মিটিং করেন না, আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ততা নেই এমন অভিযোগে বলেন, ভালো কাজে সব সময় ঈর্ষা কাজ করে। তেমনটি ধরুন আমার ক্ষেত্রে চলছে। কে কি বললো সেটা আমি মাথায় না নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে কাজ করে যাচ্ছি। আমার কাজের ফল জনগণই দেবেন। দেবেন আমার দলীয় প্রধান।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল রহিম লাল বলেন, আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান এবং মনোনয়ন বোর্ড ব্যতিত কেউই কোন মনোনয়ন বা প্রার্থীতা ঘোষনা করার এখতিয়ার রাখেন না। বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি। তবে কেউ যদি এমনটি করে থাকে তাহলে সেটা কোন অবস্থায় সঠিক হয়নি।