ইউরোপের চারটি দেশ প্রায় ১০টি খাতে বাংলাদেশ থেকে লোক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত ওই দেশগুলোতে বৈধপথে দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করছে সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে দুইপক্ষের সম্মতিতে দুই মাসের মধ্যে রোডম্যাপটি প্রকাশ করা হবে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা প্রায় দুই বছর ধরে বৈধপথে দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর জন্য আলোচনা করছি। গত সপ্তাহেও ব্রাসেলসে এক বৈঠকে এটি নিয়ে আলোচনায় রোডম্যাপ দ্রুত শেষ করার বিষয়ে একমত হয় দুইপক্ষ।’
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে জার্মানি, ইতালি, গ্রিস ও রুমানিয়া লোক নিতে আগ্রহী। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে খাতগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে আইসিটি, কেয়ারগিভিং, নির্মাণশিল্প, ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি, কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত, জাহাজ নির্মাণ ও তৈরি পোশাকশিল্প।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের এপ্রিলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম ঘোষণা করেছে। এর মাধ্যমে ইইউভুক্ত দেশগুলোর বাইরে বাংলাদেশসহ সাতটি দেশকে বিবেচনায় নিয়েছে, যেখান থেকে ইইউ দেশগুলো দক্ষ শ্রমিক নিতে চায়। সেই হিসাবে বৈধপথে ইউরোপে বাংলাদেশি পাঠানোর সুযোগ আরও বাড়বে।
ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ কী
ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ প্রোগ্রামের অধীনে ইইউভুক্ত দেশগুলো তাদের নিজ নিজ চাহিদা ইউরোপিয়ান কমিশনকে জানাবে। কমিশনে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার অধীনে একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হবে এবং প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্ত সাতটি দেশকে এ বিষয়ে অবহিত করা হবে। ম্যাচমেকিং হওয়ার পরে অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এটি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হবে। মেয়াদ শেষে অভিবাসীরা দেশে ফেরত আসবে।
এ বিষয়ে আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই চারটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা। যেমন ইতালি উচ্চমূল্যের তৈরি পোশাক বানায় এবং সে ধরনের দক্ষ শ্রমিক চাইছে তারা। আবার জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও শ্রমিক নিতে তারা আগ্রহী।’
রুমানিয়া নির্মাণশিল্পে লোক চায়। আবার গ্রিস ও ইতালি কৃষি খাতের জন্য লোক খুঁজছে। অন্যদিকে জার্মানি কেয়ারগিভার ও হসপিটালিটি খাতে দক্ষ শ্রমিক নিতে আগ্রহী বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে গ্রিসের মাইগ্রেশন ও মবিলিটি চুক্তির অধীনে প্রতি বছর চার হাজার লোক পাঠানোর কথা রয়েছে। এছাড়া সেখানে অবৈধভাবে অবস্থানকারী ২০ হাজারের মধ্যে ১২ হাজার লোককে গ্রিস বৈধতা দিয়েছে।’
অন্যদিকে ইউরোপের বাইরে থেকে ইতালি ১ লাখ ৩৬ হাজার বিদেশি শ্রমিক নেবে বলে জানায় এবং এর মধ্যে তারা বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশ থেকে বিভিন্ন খাতে ২৫ হাজার শ্রমিক নেওয়ার কোটা ঘোষণা করেছে। কিন্তু গত বছর তারা বাংলাদেশের সঙ্গে এক বৈঠকে জানায়, ওই ২৫ হাজারের প্রায় ৪৭ শতাংশ তারা বাংলাদেশ থেকে নিয়েছে।
রোডম্যাপে কী থাকবে
মাইগ্রেশন ও মবিলিটি রোডম্যাপে চাহিদার বিভিন্ন খাত, যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের ডাটাবেস তৈরি, প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ মডিউল নির্ধারণ, প্রশিক্ষণের পরে সার্টিফিকেট প্রদান, ভাষা শিক্ষা এবং শ্রমিকরা বাংলাদেশে ফেরত আসার পরে সমাজে আত্তীকরণসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ থাকবে।
এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যেটি চাই সেটি হচ্ছে শুধু দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে এবং সেখানে যেন কোনও অদক্ষ লোক না যেতে পারে সেটির জন্য একটি ব্যবস্থা করা।’
রোডম্যাপ কবে নাগাদ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করবো দুই মাসের মধ্যে এটি শেষ করে ফেলতে।’
মেগা প্রজেক্টের দক্ষ জনশক্তি
বাংলাদেশে একাধিক মেগা প্রজেক্টে অন্তত ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ করেছে এবং করছে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল বা এ ধরনের প্রকল্পে কাজ করার জন্য বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয় এবং সেটি তারা অর্জন করেছে। কিন্তু তাদের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট নেই।
এ বিষয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশেষভাবে দক্ষ ওই শ্রমিকদের বিভিন্ন দেশে কাজের সুযোগ আছে। কিন্তু সার্টিফিকেট না থাকায় তাদের চাকরির বাজার অত্যন্ত সীমিত।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ইউরোপের সঙ্গে আলোচনা করছি তাদের কাজ করার স্বীকৃতির বিষয়ে। ওই শ্রমিকদের কোনও সার্টিফিকেট নেই, এটি যেন তাদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা না হয়ে দাঁড়ায় সেজন্য আমরা ইউরোপকে অনুরোধ করেছি।’
এক্ষেত্রে মেগা প্রজেক্টে কাজ করেছে এমন প্রকৌশলীদের পাঠানো সহজ, কারণ তাদের সার্টিফিকেট আছে, তিনি উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে কারও আগ্রহ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে হাঙ্গেরি রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
কীভাবে পাঠানো হবে শ্রমিক
বাংলাদেশে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর গাফিলতির কারণে অনেক সময় চাকরিপ্রার্থীরা প্রতারিত হন। ইউরোপে যারা যাবেন তারা যেন প্রতারিত না হন সে বিষয়ে আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশে দুটি মডেল অত্যন্ত চমৎকারভাবে কাজ করছে। একটি হচ্ছে এসএসডব্লিউ (স্পেসিফায়েড স্কিলড ওয়ার্কার) মডেল, যার অধীনে জাপানে লোক পাঠানো হয়। অন্যটি হচ্ছে ইপিএস (এমপ্লয়মেন্ট পারমিট স্কিম) মডেল, যেটি দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য প্রযোজ্য। ইউরোপের ক্ষেত্রে এ দুটি মডেলের অনুরূপ বা ভিন্ন একটি মডেল তৈরি করা সম্ভব। তবে যে মডেলই ব্যবহার করা হোক, রিক্রুটিং করার এখতিয়ার ইউরোপের হাতেই থাকবে।’