ইয়াছিন আরাফাত,মহেশখালী প্রতিনিধি : জেলা প্রশাসনের এলএ শাখায় কোটি কোটি টাকা লুটপাটের সাথে জড়িত দালালরা দুদকের জালে আটকা পড়ছে একে একে। ভূমি অধিকগ্রহণে দুর্নীতির অভিযোগে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ভূমি কর্মকর্তা তহসিলদার জয়নাল দুদকের হাতে গ্রেফতার হওয়ায় মহেশখালী জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে দালালদের মাঝে।
দুদকের হাতে গ্রেফতার আতঙ্কে ইতিমধ্যে ঘরে অফিসে তালা দিয়ে পালিয়েছে এলও শাখার এক ডজন শীর্ষ দালাল। যারা ইতিমধ্যে মহেশখালীর বিভিন্ন প্রকল্পের অধিকগ্রহণকৃত জমির এলও চেক ছাড় করাতে মধ্যস্থত্বভোগি হিসেবে কমিশন বাণিজ্যে করে আসছিল।
এছাড়াও উপজেলার মাতারবাড়ী,কালারমারছড়া ও হোয়ানকের ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে গিয়ে দালালের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদের মধ্যে রয়েছেন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাংবাদিক। ইতোমধ্যে এ দালালদের মধ্যে কয়েকজনের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা জব্দ করেছে দুদক। অপরদিকে তহসিলদার জয়নাল আটকের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচিত সংবাদ প্রকাশিত হলে মহেশখালী জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ফলে নড়ে চড়ে বসেছে দালাল সিন্ডিকেটের বিশাল একটি অংশ।
দুদক সূত্রে জানা যায়, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঘুষ-দুর্নীতি চালিয়ে আসছে মহেশখালীর অধিক দালাল সিন্ডিকেট । সম্প্রতি এসব দালালের সম্পদের অনুসন্ধানও শুরু করেছে দুদক। বর্তমান অনেক বড় উন্নয়ন প্রকল্প চলছে মহেশখালীতে। পুরো জেলায় ৭০টির বেশি প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলছে। এগুলোর জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে ২০ হাজার একরের বেশি জমি। এসব জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে কমিশন বাণিজ্যই ছিল এ দালাল চক্রের মূল কাজ। দুদক সূত্রে আরও জানা গেছে, জেলায় চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথম কাজ ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে দালালদের সিন্ডিকেটটি তৈরি হয়েছে। এসব দালাল জমির মালিকদের নাম দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অপরদিকে বিষয়টি নজরে আসার পর দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধানে নামে।
জমি অধিগ্রহণে অনিয়মের প্রতিবাদে গঠিত মহেশখালী ‘জাগ্রত ছাত্রসমাজ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ফজলে আজিম মোঃ ছিবগাতুল্লাহ জানান, একটি দালাল সিন্ডিকেট তাদের বাধ্য করেছে কম দামে জমি বিক্রি করতে।
ফজলে আজিম মোঃ ছিবগাতুল্লাহ বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় জনগণের হয়রানি ও ভোগান্তির দিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমরা অনেকবার বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছি। প্রতিকার পাওয়ার বদলে আমরা পেয়েছি প্রভাবশালীদের হুমকি। উচ্ছেদের শিকার হওয়া এই মানুষগুলো এ ঘটনায় জড়িত প্রভাবশালীদের নাম বলতেও ভয় পেতেন। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তহসিলদার জয়নালকে আটক করায় হয়রানির শিকার হওয়া জমি মালিকদের স্বস্তি ফিরে এসেছে। এ অভিযান চলমান থাকলে দুর্নীতি কমে আসবে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য,উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের (তহসিলদার) মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীনকে আটক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২১ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টার দিকে চট্টগ্রামের জিইসি মোড় এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয় বলে জানা গেছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এর উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে।
জয়নাল আবেদীন কক্সবাজার শহরের পেশকারপাড়া এলাকার নুর মোহাম্মদের ছেলে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় দুর্নীতি ও নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দুদকের একটি সূত্র জানায়, তহসিলদার জয়নাল একজন উপ-সহকারী কর্মকর্তা হলেও কালারমারছড়া ইউনিয়নে সরকারের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ ভূমি অধিগ্রহণ কাজে সিন্ডিকেট গঠন করে। অবৈধভাবে শতকোটি টাকা আয়ের অভিযোগ আসে। এমনকি কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় দুর্নীতি ও নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে আটককৃত দালালদের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতেও জয়নালের নাম উঠে আসে। তার এসব দূর্ণীতির তদন্ত করতে গিয়ে সত্যতাও পেয়েছে দুদক। তবে জয়নালের সহযোগি স্থানিয় ফকিরজুমপাড়া ও নয়া পাড়ার দালালরা অধরাই রয়ে গেল। এতে জনমনে নানা প্রশ্ম সৃষ্টি হচ্ছে।
অপরদিকে তহসিলদার জয়নালের আটকের পর ২৩ জানুয়ারী দুই শীর্ষ দালাল মুহিব উল্লাহ ও সাবেক সার্ভেয়ার কেশব লাল দেবকে আটক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত শনিবার (২৩ জানুয়ারি) বিকাল ৪ টায় চট্টগ্রাম জিইসি মোড়স্থ এমইএস কলেজ গেইট এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মে জড়িত থাকা এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। আটক দালাল মুহিব উল্লাহ কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়া পালং ইউনিয়নের ফরিদ আহমদের ছেলে এবং কেশব লাল দেব কক্সবাজার এলএ শাখার সাবেক সার্ভেয়ার। বর্তমানে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখায় কর্মরত।
দুদকের একটি সূত্র জানায়, কেশব লাল দেব কক্সবাজার এলএ শাখায় থাকাকালীন সরকারের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে ভূমি অধিগ্রহণ কাজে মুহিব উল্লাহসহ শতাধিক দালাল ও সরকারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের মাধ্যমে অবৈধভাবে শতশত কোটি টাকা আয় করেছে বলে অভিযোগ উঠে।
এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করে।
দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের -২ এর উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন তহসিলদার জয়নাল আটকের ঘটনা নিশ্চিত করে বলেন তাকে গ্রেফতারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে এ কাজে অন্য যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।