হাতের টাকা আবার ফিরছে ব্যাংকে
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : উচ্চমূল্যস্ফীতি ও আস্থা সংকটের কারণে মানুষের হাতে নগদ টাকা ধরে রাখার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছিল, সেই প্রবণতা চলতি অর্থবছরে এসে কমতে শুরু করেছে। সর্বশেষ জুলাই মাসে মানুষের হাতে রাখা টাকার পরিমাণ কমেছে প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ১ মাসেই এই পরিমাণ টাকা ব্যাংকে ফিরেছে। একই সময়ে ব্যাংকে আমানত বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে ব্যাংক খাতে তারল্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে শুরু করেছে। চারটি কারণে মানুষের হাতের টাকা ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। এগুলো হলো- আমানতের সুদের হার বৃদ্ধি, নির্বাচন সামনে রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে মন্দা, ফ্ল্যাট ও প্লটের রেজিস্ট্রেশন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাসায় টাকা রাখার নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, প্রথম কারণ হতে পারে- আমানতের সুদের হার কিছুটা বৃদ্ধি। কারণ জুলাই থেকে নয়ছয় সুদের সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন নতুন স্মার্ট পদ্ধতিতে ঋণের সুদের হার নির্ধারণ হচ্ছে। এতে আমানতের সুদের হারও বাড়তে শুরু করেছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন সামনে রেখে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। এতে বেসরকারি খাতে ঋণে ধীরগতি এসেছে। ফলে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের টাকা বিনিয়োগে ব্যবহার না হয়ে ব্যাংকে ঢুকতে পারে। তৃতীয়ত, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ফ্ল্যাট ও প্লটের রেজিস্ট্রেশন খরচ বাড়ানো হয়েছে। ফলে ফ্ল্যাট ও প্লটের দামও বেড়ে গেছে। তাই মানুষ এসব জায়গায় টাকা না খাটিয়ে ব্যাংকে এফডিআর করে রাখছেন। আর চতুর্থত, বাসাবাড়ি ও অফিস-আদালতে নগদ টাকা রাখা নিরাপদ নয়। চুরি-ডাকাতির ঝুঁকি থাকে। ফলে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেও মানুষ ব্যাংকেই টাকা রাখছেন।
জানা যায়, গত বছরের শেষ দিকে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের খবর জানাজানি হওয়ার পর ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়। এর পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিতে থাকেন গ্রাহকরা। আবার সেই সময় ব্যাংকগুলোতে নতুন আমানত আসাও কমে যায়। এতে ওই ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দেশে উচ্চমূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে। কিন্তু একই সময় মানুষের আয় খুব একটা বাড়েনি। আবার উচ্চমূল্যস্ফীতির সময়ে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার যেভাবে বাড়ার কথা, সেভাবে বাড়েনি। এতে ব্যাংকে টাকা রেখে প্রকৃত অর্থে মুনাফা পাচ্ছিলেন না আমানতকারীরা। ফলে গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুনের মধ্যে মানুষের মধ্যে নগদ টাকা হাতে রাখার প্রবণতা ছিল অস্বাভাবিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকের বাইরের তথা মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা, যা ছিল এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে মানুষের হাতে নগদ টাকা বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা বা সাড়ে ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে জুন মাসেই ব্যাংকের বাইরে টাকার প্রবাহ বেড়েছিল প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা বা ১৪ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরে এসে এই চিত্র বদলে গেছে। ব্যাংকে এক মাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নগদ টাকা ফিরেছে।
দেশের মোট প্রচলনে থাকা মুদ্রা থেকে ব্যাংকে জমানো টাকা বাদ দিয়ে প্রতিমাসে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল জুলাই মাসের তথ্য প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, গত জুলাই শেষে দেশের মানুষের হাতে নগদ টাকা রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা, যা গত জুনেও ছিল প্রায় ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। ফলে এক মাসের ব্যবধানে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ কমেছে ২৫ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তবে এক বছর আগে মানুষের হাতে নগদ টাকা ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ২৬ কোটি টাকা। এতে দেখা যায়, গত এক বছরে মানুষের হাতে নগদ অর্থ বেড়েছে প্রায় ২৪ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ০৫ শতাংশ। অথচ গত বছরের জুন থেকে গত জুন পর্যন্ত এই বৃদ্ধির হার ছিল রেকর্ড ২৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাংকের বাইরে বেশি অর্থ থাকার মূল কারণ হলো- উচ্চমূল্যস্ফীতি ও আস্থার সংকট। গত এক বছরে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ সেভাবে বাড়ায়নি। এ ছাড়া গত বছরের শেষ দিকে কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়মের জেরেও মানুষের মধ্যে নতুন করে আস্থার সংকট তৈরি হয়। ফলে ওই সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে রেকর্ড পরিমাণ আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এসব আমানতের একটি অংশ এখনো ব্যাংকে ফেরেনি।
বাড়ছে আমানতও : গত জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা, যা গত জুলাই শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৬ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এর মানে, গত এক মাসে ব্যাংক খাতে সার্বিক আমানত বেড়েছে প্রায় ১২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। যদিও মেয়াদি আমানত বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ১৯ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। তবে একই সময়ে চাহিদা আমানত কমেছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। এক মাসে আমানত বৃদ্ধির কারণে গত জুলাইয়ে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধিও বেশ খানিকটা বেড়েছে। গত জুনে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, সেটি জুলাইয়ে বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
কমছে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি : চলতি অর্থবছরের শুরুতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও ধীর হয়ে পড়েছে। গত জুলাইয়ে এ খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা গত ২১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের মাস জুনে এ খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গত জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। আর গত জুন পর্যন্ত বেসরকারি ঋণস্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানেই ঋণ বিতরণ ৮ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা কমেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি ঋণ কমে যাওয়া কাক্সিক্ষত নয়। বেসরকারি খাতের ঋণ কমে যাওয়া মানে আগামীতে বিনিয়োগ কমে যাবে। আর বিনিয়োগ কমলে কর্মসংস্থানও কমে যাবে। এতে করে দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।