কভিড-১৯: জীবন-জীবিকা সুরক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক পুনর্জাগরণে কল্যাণধর্মী বিন্যাস । কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ।

পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য সারা বিশ্বে এখন তুঙ্গে। বাংলাদেশেও

0

২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-এর ২০০৮-এর নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’এ ঘোষণা দেয়া হয় বাংলাদেশেকে ‘অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসাবে গড়ে তোলা হবে।সেই লক্ষ্য সামনে রেখে   প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হয় দেশের অগ্রযাত্রা তরান্বিতকরণ। এর পূর্ব পর্যন্ত উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছিল এবং ধারাবাহিক ছিল না। রাজস্ব বছর ২০১০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে জাতীয় উৎপাদের প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবছর গড়ে ছয় শতাংশের ওপর ছিল ২০১৫ পর্যন্ত, সাত শতাংশের বেশি ছিল ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এবং ৮ দশমিক ২ শতাংশ ছিল ২০১৯ সালে।ফলে মাথা পিছু আয় বেড়ে ২০১৯ সালে ১,৯০৯ মার্কিন ডলার হয়েছে, যা ২০০৬ সালে ছিল ৫২৩ মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে জন্মের সময় গড় প্রত্যাশিত জীবন প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে, যা ২০০৬ সালে ছিল ৬৬ বছরের মত। দারিদ্রের হার নেমে এসেছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে এবং অতিদারিদ্রের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশে-  যথাক্রমে ২০০৫ সালের ৪০ শতাংশ এবং ২৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে। একইভাবে শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হারেও প্রভুত উন্নতি হয়েছে এই সময়ে। এছাড়া নারি পুরুষ ক্ষমতা-বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায সবচেয়ে বেশি সফলতা অর্জন করেছে এই সময়ে।

দেশের এসকল অর্জনের প্রেক্ষিতে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের প্রাক্কালে দিন বদলের সনদে বিধৃত উপর্যুক্ত লক্ষ্য দেশে প্রতিষ্ঠার পথ কতটা সুগম হলো বা হলো না সেই বাস্তবতার দিকে এখন নজর দেয়া যাক।

এক্ষেত্রে বিচার-বিবেচনার গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড হবে, দেশের অগ্রগতিতে সকল নাগরিকের ন্যায্য অংশীদারিত্ব এবং রাষ্ট্রীয় সকল সেবায় তাদের ন্যায্য অধিকার কতদূর নিশ্চিত হয়েছে ।তদুপরি, সকলের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার এবং আইনের শাসন নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

আর্থ-সমাজিক ক্ষেত্রে বিগত ১০ বছরে সার্বিকভাব যে নন্দিত উন্নতি হয়েছে তা আগে তথ্যসহ উল্লেখ করা হয়েছে।তবে দেশে বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়েছে।আয় বৈষম্য প্রকট- জিনি সহগ ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫, তা বেড়ে এখন শূন্য দশমিক ৪৮। জাতীয় আয়ে সবচেয়ে দরিদ্র পাঁচ শতাংশের অংশ ২০১০ সালের শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ থেকে কমে ২০১৬/১৭ সালে হয়েছে শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ। অপরদিকে সবচেয়ে ধনী পাঁচ শতাংশের অংশ ২০১০ সালের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৬/১৭ সালে হয়েছে  ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আয় বৈষম্য ক্রমবর্ধমান।ভেগ বৈষম্যও বাড়ছে এবং সম্পদ বৈষম্য বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে।

আয় বৈষম্য, বিশেষ করে সম্পদ বৈষম্য  বাড়ার পেছনে ধনীদের দক্ষতা, সক্ষমতা ও পরিশ্রম নিশ্চয় আছে, তবে অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রধানত রয়েছে দুর্নীতি, ধান্দাবাজি ও দখলদারিত্ব।বর্তমানের এই দুর্দিনেও অসহায় মানুষ-উদ্দীষ্ট ত্রাণসামগ্রী চুরি করছে কিছু অমানুষ। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে চোর বাটপাড়রা যে ব্যাপকভাবে তৎপর ছিল তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাধিক বক্তব্য থেকে জানা যায়। কিছু মানুষের চরিত্র এমন যে তারা মানুষের দুর্দশাকে নিজেদের সুযোগ ধরে নেয় । এদের সংখ্যা তখন থেকে এখন অনেক বেশি, হাতও অনেক লম্বা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রাণ চোরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বারবার বলছেন, তারপরও এরা কর্ণপাত করছে না। বস্তুত দুর্নীতিতে সারা দেশ ছেয়ে গেছে।ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি-ধান্দাবাজি দীর্ঘ দিন ধরে আলোচনা-বিশ্লেষণে আছে। এসমস্ত কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যাংক-এর অনেক পরিচালক ও কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং বড় বড় গ্রাহক। এই চক্রে থাকা উল্লেখযোগ্য অপকর্মী অনেকের নাম সর্বজনবিদিত। তাদের বিচার না হওয়ায়, অন্যরাও এ পথে যেতে দ্বিধা করে না।

পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য সারা বিশ্বে এখন তুঙ্গে। বাংলাদেশেও। এখানে পুঁজিপতিদের অনেকে রাজনীতিতেও সক্রীয়, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অধিষ্ঠিত। কাজেই বৈষম্য বাড়া যে অপ্রতিরোদ্ধ হবে এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণ ব্যহত হবে তা স্বাভাবিক বলে সে ধরে নেয়া যায়।

প্রশাসন আসলে জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক কর্মকর্তার মধ্যে দীর্ঘসূত্রিতা, দুর্নীতি ও পদ-পদবীর গৌরব প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কলুসিত করছে। আর তা ঘটছে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অনেক সৎ সদস্য থাকা সত্তেও। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশে প্রশাসন মূলত শাসকের ভূমিকায়, জনগণের সেবকের কর্মতৎপরতায় নয়। এসব কারণে জনগণের সেবাপ্রাপ্তিতে বিঘ্ন ঘটছে; সাধারণ মানুষ অবহেলিত থাকেন।

দুর্নীতি এবং হস্তক্ষেপের সংষ্কৃতি দেশে বিস্তৃতভাবে প্রচলিত থাকায় সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে আইনের য়থাযত সহায়তা ও আশ্রয় পান না।অত্যাচার, খুনখারাবি, ধর্ষণ এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন উদ্বেগজনকভাবে ঘটছে। অসাম্প্রদায়িকতায় বাংলালাদেশের অবস্থান ভাল। তবে সমাজ বিরোধী এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি সময় সময় অসাম্প্রদায়িকাতার চর্চায় প্রবৃত্ত হয়।

উপরোক্ত সমস্যা ও ঘাটতি সমূহ কলাণ রাষ্ট্র গঠনে যে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তার পরিচায়ক। এই সমস্যাগুলো আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে চিহ্নিত করে এগুলো সমাধান করার অঙ্গীকার করেছে। বলা হয়েছে-
* গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হবে;
* প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় ও সাহায্য-সহযোগিতা লাভের সুযোগ-সুবিধা অবারিত করা হবে;
* বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা হবে;
* সার্বজনীন মানবাধিকার সুনিশ্চিতে করার এবং মানবাধিকার লঙঘনের যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করার সুব্যবস্থা করা হবে।
* দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়পরায়ণ, জনগনের সেবায় নিয়োজিত ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তেলা হবে।
* স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তর (যথা: জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদ)-এর মধ্য দায়িত্ব বিভাজন সুনির্দিষ্ট করা হবে এবং এগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত জনবল ও অর্থায়ন নিশ্চিত করে যথাযতভাবে কার্যকর করে তোলা হবে।
*একটি জনবান্ধব আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে হাতে নেওয়া কাজ অব্যাহত থাকবে।
* দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা করা হয়েছে। ঘুষ, অনোপার্জিত আয়, কালে টাকা, চাঁদাবজি, খ্ণখেলাপি, টেন্ডারবাজি, পেশিশক্ত প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠুর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
*জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ভিত্তিতে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা হবে।
*বৈষম্য দূরীকরণে পরিকল্পনা ও কর্মসূচী জোরদার করা হবে এবং অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল তা বস্তবায়নে যে সকল সমস্যা বাধ সাধছে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর সমাধান করার অঙ্গীকার করা হয়েছে।এছাড়া টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ।এই কর্মসূচীর পেছনে মৌলিক নীতিসমূহের মধ্যে রয়েছে: সকলের জন্য সাম্য, অংশীদারিত্ব, মানব স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও মানব মর্যাদা নিশ্চিতকরণ। এই বিষয়গুলো কল্যাণ রাষ্ট্রে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিধৃত অঙ্গীকারসমূহ টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জরুরি কয়েকটি বিষয়। কাজেই নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকারসমূহ এবং টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার তাগিদসমূহ পারস্পরিক বলবৎকারী।

২০১৮ সালের নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠন করার পর ইশতেহারে অঙ্গীকারকৃত কিছু বিষয়ে কাজ শুরু করা হয়- যেমন দুর্নীতি দমন।এক্ষেত্রে ক্যাসিনো ও নদীর পাড় দখলকারী উচ্ছেদের জন্য জোরদার অভিযান শুরু করা হয়।টেকসই উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নিতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।দেশের আর্থ-সামাজিক দ্রুত অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে বলে দেশি বিদেশি বিশ্লেষকরা ঐকমত্যে প্রকাশ করেন।

হঠাৎ করে বিশ্বের অন্য সকল দেশের মত বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে।জীবন জীবিকা লন্ডভন্ড হতে শুরু করে, বিশেষ করে দরিদ্র পিছিয়েথাকা ও স্বল্প আয়ের কোটি মানুষের।অর্থনীতিতে নেমে আসে অশনি সংকেত। কতদিন এই মহামারি দেশে চলতে থাকে এবং কত ব্যাপক ও গভীর হয় প্রধানত তার উপর এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তা কত ব্যাপক ও গভীর বিপর্যয় ঘটায় উল্লেখযোগ্যভাবে তার উপরও নির্ভর করবে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা।তবে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যে, অর্থনীতি বিশদভাবে বিপর্যস্ত হতে যাচ্ছে। দারিদ্র এবং অতি দারিদ্র মানুষের সংখ্যা  উল্লেখযোগ্যভাবে বেড় যাবে। উপযুক্ত সহায়তা পেলে বিপর্যস্ততার কবলে পড়া অদরিদ্র অধিকাংশ দ্রত ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে আমার ধারনা। সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় রকমের ধাক্কা লাগবে দেখা যাচ্ছে। তবে এই মহামারির পূর্ণাঙ্গ অভিঘাত এখন নয়, যথসময়ে বোঝা যাবে।

এই করোনাকালে প্রথম কাজ হচ্ছে জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টা- কভিড-১৯ থেকে এবং পাশাপাশি জীবিকায় ধস থেকে। কভিড-১৯ থেকে সুরক্ষার জন্য করণীয় এখন জানা। সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হাতধোয়াসহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, মাস্ক ব্যবহার করা, পিপিই’র প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইন ও বিচ্চিন্নকরণ এবং অধিক  সংক্রমিতদের চিকিৎসা (অক্সিজ্ন, ভেন্টিলেটর)।বাংলাদেশে এক্ষেত্রে প্রচেষ্টা অব্যাহত ও ক্রমবর্দ্ধমান। তবে সুযোগ-সুবিধায় এবং সক্ষমতায় এখনও ঘাটতি রয়েছে, কাজেই প্রচেষ্টা জোরদার করা জরুরি।

দ্বিতীয় বিষয়, দেশের সর্বত্র গ্রাম ও শহরে লকডাউন এবং অর্থনৈতিক ও সেবা কর্মকান্ড বন্ধ বা সীমিত হওয়ার ফলে অসংখ্য নানুষের (দরিদ্র, পিছিয়েথাকা, চাকরী-হারানো, বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্রামে-শহরে ছড়িয়ে থাকা কুটির ও অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও ব্যবসার মালিক ও কর্মী সহ অন্যান্য) জীবিকায় যে ধস নেমেছে এবং ক্রমশ ব্যাপকতর ও গভীরতর হচ্ছে তা থেকে সংশ্লিষ্টদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন দেশে ফেরা বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের অনেক মানুষ।যে সকল দেশ থেকে তারা এসেছেন সেই দেশগুলোতে অর্থনৈতিক এখন ভঙ্গুরতা ব্যাপক এবং সংকোচন ঘটছে, ফলে অদূর ভবিষ্যতে তাদের ফেরত যাবার সম্ভাবনা নেই বা স্বল্প।

কাজেই আগামী দিনগুলো অত্যন্ত কঠিন হবে।দুর্দশায় নিপতিত উপর্যুক্ত মানবগোষ্ঠীদের বাঁচাতে সামাজিক সুরক্ষা বলয় প্রয়োজনানুসারে বাড়াতে হবে এবং সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।খাদ্যের ক্ষেত্রে, সরকারের কাছে যথেষ্ট মজুদ থাকায় এবং এবার বুরো ধান ভাল হওয়ায় দেশে চালের সরবরাহ সন্তোষজনক। প্রশ্ন হচ্ছে, খাদ্যহীনদের কাছে কেমন করে খাদ্য পৌঁছতে পারে ? ত্রাণ হিসাবে ব্যপকভাবে খাদ্য প্যাকেট বিতরণ করা বেশি দিন সম্ভব নয়। অতি দুর্দশাগ্রস্তদেরকে অনেক দিন ধরে হয়ত এভাবে খাদ্য দিতে হবে। তবে ক্রমে প্রধানত রেশনিং এবং বাজারের মাধ্যমে খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিততরণ হওয়া অধিকতর বাস্তবানুগ । সরকার ইতোমধ্যে রেশনিং-এর আওতা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে- প্রথমত   অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের রেশনিং-এর আওতায় আনা যুক্তিযুক্ত। এ সকল মানুষ এবং বাজারের মাধ্যমে যারা খাদ্য সংগ্রহ করবেন তাদের মধ্যে সহায়তা-নির্ভরদেরকে অর্থ সহায়তা দিতে হবে।এই অর্থ ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে সরাসরি প্রাপকের কাছে পাঠানো যাবে।দুর্নীতির সুযোগ কমে যাবে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বড় চ্যালেন্জ রয়েছে। এর জন্য অর্থসংস্থান নিশ্চিতকরণ মাথা ব্যথার বড় কারণ। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির সম্ভাবনাকে যতদূর সম্ভব সীমিত রাখার লক্ষ্যে জোর  প্রচেষ্টা চালাতে হবে, ভ্যাট আদায়ে বিশেষ মনোযোগ দেয়া যায়। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল থেকে অর্থসংগ্রহ  করার প্রচ্ষ্টা জোরদার করতে হবে, নীতিনির্ধারণে নিজেদের স্বকীয়তা সমুন্নত রেখে।দেশে সরকারি কার্যক্রম, বেসরকারি খাতের কার্যক্রম এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রচেষ্টাসমূহ (বিশেষ করে, এনজিও কার্যক্রম) পুনর্গঠন ও জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ ও জোরদার করতে হবে।এক্ষেত্রে স্বল্প মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা ও কার্যক্রম  গ্রহণ ও বস্তবায়নে বিশেষ মনোযোগ দেয়া জরুরি। বিভিন্নখাতের জন্য ৯৫,৬১৯ কোটি টাকার সহায়তা ও প্রণোদনা প্যাকেজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ৫ এপ্রিল   ঘোষণা করেছেন, যেটির বস্তবায়নও শুরু হয়েছে। আগামীতে নিশ্চয়ই বাস্তবানুগ আরো সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করা হবে। অবশ্যই কার্যকর ও সচ্ছ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। ২০২০-২১ সালের বাজেট কভিড-১৯ উদ্ভুত বাস্তবতা ধারন করে অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও বিন্যাস করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

তবে দিকে দিকে মানবতার উদ্বোধন ঘটতে পারে এমন কোনো শিক্ষা কি পৃথিবীর সর্বত্রগামী এবং সর্বত্র মানুষের মধ্যে
ভিতি জাগানো এই মহামারি থেকে মানুষ গ্রহণ করবে? অতীতের অভিজ্ঞতার দিকে তাকালে আশান্বিত হওয়ার মত পরিবর্তন ঘটেছে লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাজ্যে কল্পনাতীত কর্মসংস্থান ও খাদ্য-পুষ্টি সংকট সৃষ্টি হয়েছিল।তা থেকে আপামর জনসাধারণের নিস্কৃতির জন্য গণমুখী নীতির আওতায় রেশনিং ব্যবস্থা গ্রহণ করে খাদ্যের সুবন্টন প্রক্রিয়া চালু করা হয়। কর্মসংস্হান ও স্বাস্থ্যসেবায়ও সকলের ন্যায্য অভিগম্যতা নিশ্চিত করা হয়।এগুলোর সঠিক বস্তবায়নের জন্য সুশাসন নিশিত করা হয়।এই পথে ধরে অগ্রসর হয়ে দেশটিকে কল্যাণ রাষ্টে রূপান্তরিত করা হয়। সকল নাগরিকের জন্য মানব মর্যাদাপূর্ণ জীবনমান নিশ্চিত করা হয়। সকলের জন্য সব মানবাধিকার নিশ্চিত হয় এবং সমসুযোগ সৃষ্টি হয়।

এই উদাহরণ আশার উদ্রেক করে যে, কভিড-১৯ থেকে ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়াও একটি মানব কল্যাণমূলক প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। বিশ্ব মানব মানসে এই লক্ষ্যে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হতে পারে, যার প্রভাবে বিশ্বব্যবস্থায় মানবীকিকরণ শুরু হতে পারে।

আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বালাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বিশেষ কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা
দিয়েছিলেন ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে এবং ঐ পথে বাধাদানকারি কাঁটাগুলো চিহ্নিত করছেন ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে। প্রচলিত বাস্তবতায় ঐ প্রতিবন্ধকতাগুলো
হটানো সহজ হতো বলে আমার মনে হয় না। করোনাভাইরাস জনিত মহামারি সম্পূর্ণ এক নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে। কোনো ক্ষমতাবান এর বিহিত করার কোনো ক্ষমতা রাখেন না। সব মানুষ সব মানুষের জন্য, সবে মিলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত কল্যাণ রাষ্ট্র বাংলাদেশে গড়ে তোলার এক উজ্জ্বল সুযোগ সমাগত বলে আমার মনে হয়। দুর্নীতি-দুবৃত্তায়ন-দখলদারিত্ব-ক্ষমতার দৌরাত্ম্য-অনাচার দূর করে সুস্থ পরিবেশে প্রস্তাবিত কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করার জন্য  করোনাভাইরাস উদ্ভুত বাস্তবতা খুবই উপযোগী বলে আমার ধারনা। কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া শুরু করা হলে বিদ্যমান এই বাস্তবতায় সব অঙ্গনের নেতৃস্থানীয়রা আগ্রহসহকারে বা অবস্থার চাপে পড়ে অংশীদার হবেন। শুরু করা যায় যুক্তরাজ্যের মত (উপরোক্ত) খাদ্য, কর্মসংস্হান ও স্বাস্থ্যসেবায় সকলের ন্যায্য অভিগম্যতা সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় সুশাসনের মাধ্যমে নিশ্চিত করে। পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও জন-কল্যাণধর্মী কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের তৎপরতা চালানো বান্চনীয়। বিশেষ নজর দেয়া জরুরি  ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে চিহ্নিত গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার ক্ষেত্রে। তদুপরি অনমনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঐ ইশতেহারে চিহ্নিত প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করে কাঙ্খিত টেকসই উন্নয়ন ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

 

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.