চা বাগানে শিক্ষার্থীদের ‘আলো’ সন্তোষ রবি দাস অঞ্জন । হীরেন পণ্ডিত
চা বাগানের কথা শুনলেই সবার চোখের সামনে উঁচু নিচু সবুজে সারিবদ্ধ ঘন চা গাছের নয়নাভিরাম স্বর্গীয় দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। কিন্তু দুটি পাতা একটি কুড়ির এ চা বাগানগুলোতে যাদের জীবনগাঁথা সেই চা শ্রমিক এবং তাদের জীবনধারার নিদারুণ কষ্টের নীরব আর্তনাদ কেউ দেখার চেষ্টা করেনা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বসবাস শুরু করলেও চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার দেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের পর। বর্তমানে চা শিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক ১০ লাখ ৷ শ্রমিকদের মধ্যে ৭৫ ভাগই মহিলা শ্রমিক। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে চা জনগোষ্ঠীর মাঝে। চা বাগান গুলোতে বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি। ফলে চা বাগানের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা এসব এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ে শুরু হয়। এছাড়াও চা বাগানেই চা বাগান কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি সহযোগিতায় মোট ১১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। তবে চা বাগানের শিশুরা যুগোপযোগী প্রাথমিক শিক্ষায় আসেনি। এসব বেশিরভাগ বিদ্যালয়ই এখনো জাতীয়করণ করা হয় নি যার জন্য শিক্ষকদের বেতনভাতা সংক্রান্ত টানাপোড়ন থাকছেই।
পড়াশুনা শুরুর পর চা বাগানের শিক্ষার্থীরা আটকে যায় ভাষাগত কারণে। চা বাগানের শিশুরা নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা পরিবারে শিখে এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে। প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরুলেই ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রধানত দারিদ্র্যতার কারণে বেশিরভাগ ছেলে মেয়েকেই জীবন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে হয়ে। এ লড়াই বেঁচে থাকার। যে সকল শিক্ষার্থী দারিদ্র্যতার সাথে পেরে উঠতে পারে তারা স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজেও পড়ছে। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় জর্জরিত শিক্ষা জীবনে মাধ্যমিকে ভালো ফল না থাকায় অনেকেই ভাল কলেজে ভর্তি হতে পারে না। এমনিভাবে উচ্চ মাধ্যমিকেও ভাল ফল না থাকায় সরকারি কলেজেও সুযোগ পায় না। ফলে যারা নিজস্ব আগ্রহে পড়তে চায় তারা ডিগ্রী কোর্সে ভর্তি হয়।
দারিদ্র্যসীমার নিচে চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর বসবাস। দু’বেলা খাবার জোগাড় করার জন্য রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে রুগ্ন শরীর নিয়ে চা-বাগানে কাজ করতে হয় তাদের। থাকা-খাওয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যে যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করতে পারে না ৫০ শতাংশ চা-শ্রমিকের সন্তান, সেখানে উচ্চশিক্ষা শুধুই বিলাসিতা বললেই চলে। দেশের ১৬২টি চা-বাগানে প্রায় ১০ লাখ চা শ্রমিকের বসবাস, যাদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই সামান্য। এরপরও চা-শ্রমিকদের সন্তানদের মধ্যে অদম্য কিছু শিক্ষার্থীর দেখা মেলে মাঝে মধ্যে। যারা ১০ লাখ চা শ্রমিকের সন্তানদের স্বপ্ন দেখান, বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামের কথা জানান এবং লড়াইয়ের বীজ বুনে দেন। এদের একজন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর চা-বাগানের বাসিন্দা সন্তোষ রবি দাস অঞ্জন । সমাজে পিছিয়ে পড়া চা জনগোষ্ঠীর সন্তান সন্তোষ রবি দাস। বেড়ে উঠা চা বাগানেই। চা বাগানের মধ্যে পিছিয়ে পড়া রবিদাস সম্প্রদায়ের সাবেক চা শ্রমিক সত্যনারায়ণ রবি দাস ও মা কমলি রবি দাসের ছেলে সন্তোষ রবিবদাস। মাত্র ছয় মাস বয়সে বাবাকে হারিয়ে মায়ের কষ্টের আয়ে বেড়ে ওঠেন তিনি।
নিজ যোগ্যতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিভাগ মাস্টার্স শেষ করেছেন। তবে সুযোগ পেলেই বাড়িতে ফিরে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র চা শ্রমিকদের সন্তানদের জীবনমান উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য সচেতনতায় কাজ করছেন। তাদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা ও মতবিনিময় করছেন তিনি। এভাবে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের শমশেরনগর চা বাগানের ফাঁড়ি কানিহাটি চা বাগানে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘আলো’ হয়ে দেখা দিয়েছেন সন্তোষ রবি দাস। এখন সন্তোষ রবি দাস কানিহাটি চা বাগানে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন। করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সময়ও তিনি চা বাগানে সপ্তাহে পাঁচ দিন শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। সপ্তাহে এক দিন নেন তাদের পরীক্ষা। সপ্তাহের এক দিন সমাজের নানা সমস্যা, সম্ভাবনা, ধর্মীয় আচার রীতি ও স্বাস্থ্যসচেতনতা নিয়ে আলোচনা করতেন। শিক্ষার্থীদের দেওয়া হতো শিক্ষা উপকরণ।
সন্তোষ রবি দাস নিজের কষ্টের দিনের কথা কখনো ভুলতে পারেন না। তাই নিজের জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করছেন তিনি। সন্তোষ রবি দাস জানান, তাঁর মা আগে দৈনিক মজুরি পেতেন ৮৫ টাকা। এখন পান ১২০ টাকা। মায়ের এ আয়ে তাঁদের সংসার চালানো কঠিন ছিল। তাঁর মা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ক্ষদ্রঋণ নিয়ে ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জুগিয়েছেন। আর ঋণের কিস্তি পরিশোধে চা বাগানের কাজের পাশাপাশি পাহাড়ি ছড়ায় বালু উত্তোলনের কাজ করেছেন। সংসারে মা-ছেলে আলুসেদ্ধ খেয়ে বহু রাত কাটিয়েছেন। সন্তোষ রবি দাস জানান, চা বাগানে এখন আর আগের অবস্থা নেই। বর্তমানে শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্যানিটেশনের সুবিধা বেড়েছে। খরচ ও প্রতিযোগিতাও অনেকটা বেড়ে গেছে। তবে উচ্চশিক্ষার সুযোগ এখনো সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না চা জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা। তাই তিনি নিজের উদ্যোগে চা বাগানে গড়ে তুলেছেন শিক্ষা সহায়তা কার্যক্রম। ‘একে অন্যকে সাহায্য কর’ শ্লোগানে চা বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছেন তিনি।
আবার মাঝেমধ্যে বড় আকারের আলোচনা সভা ও সচেতনতামূলক সভা করেন চা বাগানের নাচঘরে। এলাকার পত্রিকায়ে এ বিষয়ে খবর প্রকাশিত হবার পরে সনাতন মৈত্রী ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক রাজীব সাহা ৩জনকে একটা ন্যূনতম সম্মানী দেওয়ার কথা বলেন অক্টোবর থেকে উক্ত প্রতিষ্ঠানটি এক বছরের জন্যে তিনজনকে শিক্ষক হিসাবে ন্যূনতম সম্মানী দেওয়ার নিমিত্তে একটি নিয়োগ পত্র প্রদান করেন। এইরকম একটি প্রতিষ্ঠান দরকার যাঁরা চা বাগানের বাচ্চাদের আইসিটি বিষয়ে সহায়তা প্রদান করে তাদেরকে ডিজিটাল বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য তথ্য প্রযুক্তিতে অবদান রাখতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী থাকা কালে সন্তোষ রবি দাস অঞ্জন লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কয়েক বছর ধরেই সক্রিয়। তিনি ‘বিশ্ববিদ্যালয় চা-ছাত্র সংসদ’র, উপদেষ্টা , ‘একটি বিদ্যার্থীর দৃষ্টি সংঘের’ সভাপতি, ‘বাংলাদেশ রবিদাস ছাত্র পরিষদের’ দফতর সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের স্বেচ্ছাসেবী সদস্য। সন্তোষ রবি দাস অঞ্জন বলেন, চা-বাগান থেকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে আসতে তার যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছে, তা শুধু তিনিই বুঝতে পারে যিনি এ পর্যন্ত এসেছেন।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সন্তানরা বুঝে একটি ভালো পরিবেশে আসতে কতটুকু কষ্ট ও সংগ্রাম করা লাগে। অঞ্জন খুব অনুভব করেন এই কষ্টগুলো। সন্তোষ রবি দাস অঞ্জন আরও বলেন, ছাত্র সমাজের সামাজিক উন্নয়নের জন আমি অবহেলিত শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করি।
আমাদের চা-বাগানের শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিজ্ঞান খুবই কম। তারা তাদের আইটি স্কিল ডেভেলপমেন্ট করা প্রয়োজন কিন্তু সুযোগের অভাবে হাজারো শিক্ষার্থী পিছিয়ে রয়েছে এইরকম উন্নয়নের ক্ষেত্র থেকে। যদি একটা আইসিটি ল্যাব তৈরি করা যায় তাহলে সবাই পারবে বিভিন্ন ধরনের স্কিল ডেভেলপমেন্ট করে নিজের উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ফ্রিল্যান্সিং কাজ করতে। চা বাগানের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনা ভালোভাবে চালিয়ে যেতে প্রয়োজন একটা সুন্দর মূহূর্তের যা ছাত্র-ছাত্রীরা একটা পাঠাগারের মাধ্যমে পেতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের রেফেরেন্সের জন্যে একাডেমিক বইয়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে যা একটা লাইব্রেরি বা পাঠাগারের মাধ্যমে পেয়ে থাকি ছাত্র-ছাত্রীরা। এই সুবিধা থেকে চা বাগানের ছাত্র-ছাত্রীরা বঞ্চিত। এই উন্নয়নের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে এই চা বাগানে একটা লাইব্রেরি স্থাপন করা জরুরি প্রয়োজন। সংস্কৃতির আধার চা বাগানগুলো। প্রত্যেক চা বাগানের মধ্যে ৯৪/৯৫ টা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের বসবাস যাদের নিজস্ব কৃষ্টি, আচার-আচরণ রয়েছে। এইসবের বিকাশের জন্যে প্রয়োজন একটা কালচারাল একাডেমি। বর্তমান চাকরির প্রতিযোগিতার বাজারে অনেক পিছিয়ে রয়েছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর চা-শ্রমিকের সন্তানরা। তাদেরকে তুলে ধরতে প্রয়োজন আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সুবিধা সম্বলিত একটা জব প্রিপারেশন হোম যার কল্যাণে তারা তাদের চাকরি ক্ষেত্রে প্রবেশের পথ সহজ করতে পারবে। আমরা যদি স্বাস্থ্য সেবার কথা চিন্তা করি তাহলে আমাদের করুণ দৃশ্যই চোখে পড়ে। প্রতিটি মানুষের উন্নত প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দরকার একটা ক্লিনিক যার মাধ্যমে চা-শ্রমিকের জরুরি চিকিৎসা দেওয়া যাবে।
এই উদ্যোগের কথা চিন্তা করে সনাতন মৈত্রী ফাউন্ডেশনের সাথে যোগাযোগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও খ্রিস্টান এইডের বিভাগীয় সমন্বয়কারী মোহন রবিদাস। এই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক রাজিব সাহা,মোহন রবিদাসকে উক্ত ফ্রী কোচিংয়ের তিনজন শিক্ষককে মনিটরিং ও স্কুলের কার্যক্রম দেখার দায়িত্ব দেন। এই তিনজন শিক্ষক হলেন ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী সন্তোষ রবি দাস, ধরম রবিদাস ও লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী সুজন রবিদাস। এ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করতে পেরে তিনজন শিক্ষকই অনেক উপকৃত হয়েছেন। চা-বাগানের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার যাদের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর, ট্যাগ টা সরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারবে চা বাগানের মানুষ।
চা বাগানের শিশুরাও এ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। চা-শ্রমিকের পরিবারের আমানত শূণ্যের কাছাকাছি কারণ তারা তাদের সন্তানের পড়াশোনা করানোর জন্য ভালো প্রাইমারি স্কুল পাচ্ছেনা। ভালো ভালো স্কুলগুলো শহরের ভেতরে যাতে পড়াশোনার খরচ অনেক যা একজন চা-বাগানের পিতামাতার পক্ষে খরচ চালানো অসম্ভব। তাই এই সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্যে সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসতে হবে এবং সরকার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
একজন চা শ্রমিক দৈনিক মজুরি মাত্র ১২০ টাকা পান। এই মজুরি দিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারই জোগাড় হয় না, আর সন্তানের শিক্ষার আয়োজন করা তা তো প্রায় অসম্ভব। এর রকম পরিস্তিতিতে স্কুলের মাসিক বেতন, বিভিন্ন ফি, বাধ্যতামূলক কোচিং, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদি আয়োজন নিশ্চিত করে বাগানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। আবার যে অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীরা স্কুলের সীমা অতিক্রম করে, তারাও আর্থিক অসংগতি, নানা সীমাবদ্ধতার কারনে বেশিদূর এগুতে পারে না। ফলে যুগ যুগ থেকে চা জনগোষ্ঠি সমাজ সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। তাই চা বাগানে শিক্ষার ন্যূনতম আয়োজন আজ পর্যন্ত নিশ্চিত হলো না, কেন হলো না এর উত্তর নেই? গত দেড়’শ বছরে অনেক কিছু পাল্টালেও, চা জনগোষ্ঠির এই জীবন আজও পাল্টায়নি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি