টেকসই উন্নয়নে পরিবেশ ও নদী । হীরেন পণ্ডিত
ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ নদ-নদী এখন দখল-দূষণ-বর্জ্যে মৃতপ্রায়। বিশেষ করে ঢাকাকে ঘিরে শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বুড়িগঙ্গার সর্বত্রই চলছে দখলবাজদের আগ্রাসী থাবা। ঢাকার বাইরেও প্রায় সব জেলা উপজেলা থেকে আমরা একই ধরনের খবর আমরা পাই গণমাধ্যমে। তবে সবচেয়ে বড় খবর হলো, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দখলের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে। বুড়িগঙ্গার ৬৭টি বড় দূষণ মুখের মধ্যে ৫৬টি ঢাকা ওয়াসার আওতায়। আর তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা দূষণেও বেসরকারী শিল্পকারখানার চেয়ে পিছিয়ে নেই বিসিক, কয়েকটি সিটি করপোরেশন। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই আগ্রাসী থাবায় নদী আজ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। যে কোনো নদীর পাড়ে চোখ মেলে তাকালেই দখলবাজির পরিমাণটাও স্পষ্ট হয়ে যায়। অবস্থা এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছে, অনেক নদ-নদীর অস্তিত্বই এখন হুমকির সম্মুখিন। অনেক নদীকে আর বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। দখল ও দূষণের কারণে গত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে গিয়ে হয়েছে ৬ হাজার কিলোমিটার এর মতো। কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। নদী-জলাশয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
পরিবেশ সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, একেবারে শীর্ষ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের পদাধিকারীরা বলে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশও খুব একটা অগগতি হয়নি। সংকট তাহলে কোথায়? দখল-দূষণকারীদের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃঢ়তায় ও সদিচ্ছায় অভাব রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়, কিছু দূর যাওয়ার আগেই তা আবার থেমে যায়। নদ-নদী রক্ষা করতে হবে জাতীয় স্বার্থকে সব ধরনের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে। নদী রক্ষায় নীতি ও আইন রয়েছে। এসব নীতি ও আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি পানি ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে হবে। নদীকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দিতে হবে।
পরিবেশ বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব। আমাদের অসচেতনতার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। জীবনধারণের স্থান ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। তাই আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই সচেতন না হলে শুধু আইন প্রয়োগে খুব বেশি সফলতা আসবে না। পরিবেশকে বিবেচনায় না রেখে একটি সুন্দর পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। পরিবেশ আর উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্ক পরস্পরবিরোধী নয়। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। পরিবেশকে রক্ষা করে দেশের উন্নয়ন না করলে তা টেকসই হবে না। এজন্য শুধু সরকার বা বিভিন্ন সংস্থাকে কাজ করলে চলবে না, সমাজের প্রত্যেক মানুষকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করত হবে। পরিবেশ বাঁচিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সম্ভব করতে হবে।
সারাবিশ্বের পরিবেশবাদী মানুষ নদী রক্ষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। পরিবেশের সঙ্গে পানি ও নদীর গুরুত্বপূর্ণ সংযোগই কি এর একমাত্র কারণ! নাকি নিজেদের জীবন-জীবিকায় নদীর অসীম গুরুত্ব রয়েছে এই বিবেচনায় মানুষ তা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ এবং নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে? নানা কারণেই আমাদের দেশে দেশের প্রধান প্রধান নদী দিন দিন বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। সবকিছুই পরিবেশের ভারসম্যা রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য, পরিবেশ বাঁচানো এবং নদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে।
ঢাকার হাজারীবাগ, তেজগাঁও ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরার নদী রক্ষা বাঁধ ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের প্রায় সাত হাজার কারখানা। এসব শিল্প-কারখানার শিল্পবর্জ্য সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। বুড়িগঙ্গা থেকে এ শিল্পবর্জ্য গিয়ে মিশছে তুরাগ, টঙ্গী খাল, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীতে। এর বাইরে রাজধানীর গৃহস্থালি বর্জ্যেরও গন্তব্য হচ্ছে বুড়িগঙ্গা। কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই এসব বর্জ্য এসে নদীটিতে মিশছে। সেখান থেকে তা আবার বিভিন্ন মাত্রায় ছড়াচ্ছে আশপাশের অন্যান্য নদীতে।
সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীর পানিতে ১১ ধরনের ক্ষতিকর ধাতুর দেখা মিলেছে। গবেষণায় যেসব নদী, হ্রদ বা খালের দূষণের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বংশী, ধলাই বিল, মেঘনা, সুরমা, কর্ণফুলী, হালদা, খিরু, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা, পশুর, সাঙ্গু, কাপ্তাই লেক, মাতামুহুরী, নাফ, বাকখালি, কাসালং, চিংড়ি, ভৈরব, ময়ূর, রাজখালি খাল। আর এসব জলাধারের পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে জিংক, কপার, আয়রন, লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কার্বন মনোক্সাইড ও মার্কারির উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন গত ৪০ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ আশপাশের অবিচ্ছিন্ন নদীগুলো চরম মাত্রার দূষণের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে বড় নদীগুলো থেকে দেশের প্রায় সব নদীতেই বিভিন্ন মাত্রায় দূষণ পৌঁছে গিয়েছে। শিল্পবর্জ্যের ভারী ধাতু পানিতে মিশে নদীর তলদেশে মারাত্মক দূষণ তৈরি করে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে নদীর পানিতে ক্ষতিকর ধাতুর ঘনত্ব বেশি পাওয়া যায়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় শূন্য পাওয়া গেছে। পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না থাকলে মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব।
নদীর দূষণ কমাতে এখনই সচেতন হতে হবে। নদীর দূষণ প্রতিরোধ কেবল সরকারের একার কাজ নয়। সবাইকে সচেতন হতে হবে। নদীদূষণের ফলে আমাদের উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যও দূষিত হয়ে পড়েছে। মানুষের খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন ভারী ধাতু মানবদেহে সরাসরি প্রবেশ করছে। দীর্ঘদিন এসব দূষিত খাবারের কারণে মানুষের শরীরে ক্যান্সারের মতো রোগ হতে পারে।
নদীদূষণ রোধে প্রথমেই নজরদারি বাড়াতে হবে। যেসব কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে তা উৎস থেকে নজরদারির মাধ্যমে বন্ধ, দূষিত তরল নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে। এর জন্য যে আইনগুলো আছে সেগুলো প্রয়োগ জরুরি। নদীর প্রাণপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য, নদীগুলোর রাসায়নিক ও জীববৈচিত্র্যগত মান বজায় রাখার জন্য বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নদী রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কেবল শাস্তি দিয়ে বা সরকারের একার পক্ষে নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব না। এজন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাদের কাছে নদীর উপযোগিতার কথা ব্যাখ্যা করতে হবে। পাশাপাশি দূষণের সঙ্গে জড়িতরা যাতে যথাযথ শাস্তি পায়, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের স্বার্থে নদী রক্ষা করতে হবে। বাঁচাতে হবে দেশের সব নদী। সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী সংস্কার ও পরিচর্যার গুরুত্ব বিবেচনা করেই কাজ করতে হবে। নদী না বাঁচলে বাংলাদেশকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে, অর্থাৎ বাংলাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। আমাদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য সবকিছুর সঙ্গে আমাদের নদীগুলো সম্পর্কযুক্ত। হাজার বছর ধরেই এসব নদ-নদী আমাদের কৃষি, প্রকৃতি ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। নদী রক্ষা না করলে তাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা পাবে না। এ জন্য নদী রক্ষাকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে নদ-নদী বাঁচাতে খুব দ্রুত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে নদী মাতৃক বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে নদী রক্ষা তথা নদীর নাব্যতা ধরে রাখার বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়নেও প্রয়োজন নদী রক্ষা ও পানির সঠিক ব্যবহার। নদীই বাংলাদেশের প্রাণ। কাজেই দেশের প্রাণশক্তি রক্ষা করতে হলে নদী দখল বন্ধ ও নদী দূষণরোধ করতেই হবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সংরক্ষণ করে যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যায় তাকে টেকসই উন্নয়ন হিসেবে গণ্য করা হয়। সরকার এজন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এমডিজি বাস্তবায়ন করেছে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (২০১৫-২০৩০) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। গবেষণায় জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহৃত হয়েছে ৬৮ বিলিয়ন টন। ২০৫০ সালে ব্যবহৃত হবে ১৪০ বিলিয়ন টন, যা পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করবে। মানুষের কারণে ২০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি, ৩০ শতাংশ বনভূমি এবং ১০ শতাংশ চারণভূমি হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে আবাসন ও শিল্পায়নের কারণে প্রতি বছর ১ শতাংশ কৃষি জমি কমছে। জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে। অর্ধেকেরও বেশি নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকিগুলো দখলে বিপর্যস্ত।
টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনীতি আমাদের প্রয়োজন সেই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে নদীকে তার হারানো গৌরব ও যৌবন ফিরিয়ে দিতে হবে। নদী আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। টেকসই উন্নয়ন ও নদী রক্ষায় সবাইকে নিয়েই সামনে এগুতে হবে। নদীর ব্যবহার এখন বহুমাত্রিক। মানুষ বুঝে না বুঝে নদীকে ব্যবহার করছে। নদীর কাছেই গড়ে ওঠেছে বড় বড় কলকারখানা, নদীতে এখন হাজার হাজার লঞ্চ স্টিমার। নদীতে শত শত বাধ। যখন যেভাবে প্রয়োজন তখন সেভাবেই নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পৃথিবীতে এখন প্রায় ৭৮ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারেনা। আর আড়াইশ কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। বছরে ৬০-৮০ লাখ মানুষ পানিবাহিত অসুখে মারা যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পানির সহজলভ্যতা কমছে দিন দিন। যদিও বিশ্বে ২০৫০ সাল নাগাদ শুধু কৃষি কাজে ব্যবহৃত পানির পরিমাণ ১৯ শতাংশ বাড়তে পারে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কিংবা নীতিগত মধ্যস্থতা না হলে এটা আরো বাড়তে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে নদীগুলো ঘন ঘন গতিপথ পরিবর্তন করে। ফলে বাংলাদেশে চর জেগে উঠা জমি একটি সাধারণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে এবং চাষযোগ্য জমি ক্রমশ কমছে। সারা বাংলাদেশে ৩২টি জেলায় প্রায় ১০৯টি চর উপজেলা রয়েছে। ছোট এই দেশের মধ্যে দিয়ে ছোট বড় সাতশর মতো নদী বয়ে গেছে। মানুষের পেশা, জীবনযাপন এবং সাহিত্য সংস্কৃতি সবকিছুই নদীর উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্ভরশীল। আমাদের দেশে নদীর কাছে যে জমি চাষ করা হয় তাতে ব্যবহার করা হয় নদীর পানি। উৎপাদিত ফসল শহরে নিয়ে যাওয়া হয় নদী পথে। নদী আমাদের সমাজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং জাতীয় জীবন অর্থনীতির চালিকা শক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম উপাদান হিসেবে ভ‚মিকা পালন করছে। নদীর গুরুত্ব বোঝাটা তাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রত্যাশিত বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা বাড়বে ৫০ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে হবে ৭০ শতাংশ, যেখানে হাইড্রো পাওয়ার এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদসহ মোট জ্বালানি চাহিদা বাড়বে ৬০ ভাগ। বর্ধিত কৃষি উৎপাদনের জন্য বিপুলভাবে পানি ও জ্বালানি চাহিদা উভয়ই পানি ব্যবহৃত ক্ষেত্রগুলোয় প্রতিযোগিতা বাড়বে।
অর্থনীতি সচল রেখেই পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। আবার পরিবেশের জন্য অর্থনীতিকেও সচল রাখতে হবে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থেই নদীকে ফিরিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু প্রকৃতির অপার দান আমরা নদীকে আমরা রক্ষা করতে পারছি না। পরিবেশ একা রক্ষা করা যায় না। সবাইকে নদী ও পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। অর্থনীতি সচল রেখে যেমন আমাদের কাজ করতে হবে তেমনি আমাদের পরিবেশও রক্ষা করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির জন্য আঞ্চলিক অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম। তার জন্য ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে সমঝোতা রয়েছে তার ভিত্তিতেই আমাদের নদী ব্যবস্থাপনা জোর দিতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে হবে। নদী ও পরিবেশ রক্ষা করে আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নদী রক্ষায় ১৯৯৯ সালের পানি নীতি এবং ২০১৩ সালের ওয়াটার অ্যাক্ট বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে নদী সমস্যার সমাধান করা জরুরি। তার জন্য সবার আগে যে কোনো পরিকল্পনার সাথে ভুক্তভোগি ও ক্ষতিগ্রস্তদের সম্পৃক্ত করে কাজ করতে হবে।
জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব আমরা লক্ষ্য করেছি। জলবায়ুর অভিঘাত পানির উপরে পড়ে এবং পানির সাথে আমাদের কৃষি ও পরিবেশসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও পড়ে। তাই নদীর প্রবাহতা অক্ষুন্ন রেখে কাজ করতে হবে। অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীকে গুরুত্ব দিয়ে এগোতে হবে। পাশাপাশি চীনের সাঙ্গু থেকে যমুনার যে প্রবাহ সে বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে হবে।
নদী দখল, নদী দূষণের জন্য দায়ী আমাদের দেশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার নদী দখলকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে নদীকে রক্ষা করতে হবে। বালু উত্তোলন ও বর্জ্য ফেলা নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এগোতে পারলে আমরা অবশ্যই নদীকে বাঁচাতে পারব। আর এসবের জন্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও তরুণ প্রজন্মের ঐক্যের মধ্য দিয়ে নদী রক্ষা করতে হবে। জলবায়ুর অভিঘাত থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে।
করোনা সঙ্কটের মতোই বন্যা ও নদী ভাঙন দেশবাসীর জন্য মহাসঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলাবদ্ধতা আজ মানুষের জন্য একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসবের জন্য নদীর নাব্যতা নিশ্চিত করে নদীকে রক্ষা করতে হবে। নদীর উপকারভোগী আমরা সবাই, তবে সরাসরি কিছু অংশীজন রয়েছে যারা একইভাবে নদীকে শোষণ করছেন বেশি। যেমন কিছু ফ্যাক্টরি বা কারখানা, হাসপাতাল, লঞ্চ স্টিমার ব্যবসায়ী ও দখলদারগোষ্ঠী। এমন চলতে থাকলে পানি কৃষি কাজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাবে। আর একই সাথে ছড়াবে নানা রকমের রোগ-বালাই। নদী দূষণের ফলে ইতোমধ্যে মাছের শরীরে নানা রকম অসুখ দেখা দিচ্ছে যা আমাদের মানব শরীরের জন্যও ক্ষতিকর। পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে দিন দিন। দেশে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে নদী দখল দূষণ বন্ধ করতে হবে। মুনাফালোভী ও নদীখেঁকো দখলদারদের কারণে দেশের নদ নদীগুলো ধ্বংসের মুখে রয়েছে তাদেও কাছ থেকে নদীকে রক্ষা করতে হবে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের কাছে নদী তার চির চেনা রূপ হারাতে বসেছে। বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী দেশের আন্তঃনদী মোট ৫৭টি। এর মধ্যে ৫৪টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে। টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে এ অবস্থায় প্রধান করণীয় হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মতো নতুন কৌশল উদ্ভাবন এবং সেগুলো প্রয়োগ করা মানুষের দুর্ভোগ কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া লবণাক্ত পানির প্রকোপ থেকে ফসলি জমি যতটুকু পারা যায় রক্ষা করা, খরা, নদী ভাঙন ইত্যাদি দুর্যোগে অধিক সংখ্যায় মানুষ যাতে বাস্তুচ্যুত না হয়, এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া, জলবায়ু সহনশীল কৃষি পদ্ধতিতে উদ্ভাবন করা।
প্রতিটি জেলায় নদী রক্ষা কমিটি রয়েছে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে। নদী ভরাট ও অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে সকলকে নিয়ে কাজ করা, নদী খননের প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদন ও নদী রক্ষায় নানা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজ করে এই কমিটি। কিন্তু শুধু জেলা প্রশাসন অথবা পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী বাঁচাতে পারবে না। এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে। তেমনি এসব কাজের জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির জন্য আঞ্চলিক অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব প্রদান খুব জরুরি। তার জন্য ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে সমঝোতা রয়েছে তার ভিত্তিতে আমাদের নদী ব্যবস্থাপনা জোর দিতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো