মহামারির কারণে বাড়ছে শিশুশ্রমের ঝুঁকি । হীরেন পণ্ডিত
‘শিশুশ্রম’ শব্দটার সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত এবং চোখের সামনে অহরহ দেখছি। শিশুশ্রমের আক্ষরিক অর্থ হলো ‘শিশুদের দ্বারা শ্রম’ বা শিশুদের মাধ্যমে যে শ্রম তাই শিশুশ্রম। এর সর্বজন গ্রাহ্য অর্থ হলো আর্থিক লেনদেনসহ অথবা আর্থিক লেনদেন বা খাবার দেয়া বা যে কোনো কিছুর বিনিময়ে শিশুদের কোনো কাজের জন্য নিয়োগ করা হলে তা শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে। কিন্তু, শোষণমূলক বিবেচেনায় অনেক দেশই এই শিশুশ্রমকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
বর্তমান বিশ্বে ১৫ বছরের নিচে প্রায় এক-দশমাংশ শিশু বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পেশায় বা কাজে নিযুক্ত রয়েছে। এদের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকা দুইই হয় চরম দারিদ্র্য আর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে, জীবনের শুরুই হয় নানা বঞ্চনার আর অবহেলা দিয়ে। উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ ও দক্ষতা উন্নয়নের কোনো সুযোগ থেকে তারা থাকে নির্বাসিত এবং এগুলো তাদের জীবনে হয়তো এগুলো স্বপ্ন হয়ে চোখের সামনে ভাসে।
আইএলও’র সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বের প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম বিক্রি করছে। এদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত প্রায় সাড়ে আট কোটি শিশু। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত জাতীয় শিশু জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত আছে প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে দেশের ১৩ লাখ শিশু। বর্তমানে এই সংখ্যাটা আরো অনকে বেশি। ২০০৬ সালের শিশু সনদে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের সার্বিক শ্রম এবং ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে কারখানায় ১৮ বছরের কম বয়সের শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের সময়সীমা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০২১ সালের মধ্যে দেশ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ হলেও তা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে কয়েক দফা সময় পেছালো সরকার। সম্প্রতি নতুন করে ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
আমরা এখনো শিশুশ্রম কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করতে পারছি না। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। দরিদ্র্যতা, অশিক্ষা, অসচেতনতা, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা শিশুদের শ্রমের ঠেলে দিচ্ছে। আবার শিশুদের সস্তা শ্রমের জন্য কতিপয় অসাধু ব্যক্তি নানা রকম প্রলোভনে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে টেনে আনে। সরকারি হিসাব মতে, দেশে ৩৪ লাখ শিশু শ্রমে এবং ১২ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সব রকম শিশুশ্রম বন্ধ করার তাগিদ আছে। অথচ চারপাশে তাকালেই দেখা যায়, কত শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে।
সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে একটি জরিপ শুরু করেছে সরকার। ১০ বছর আগে একটি জরিপ করা হয়। তারও ১০ বছর আগে আর একটি জরিপ হয়। এই দুই জরিপের ব্যবধানে শিশুশ্রম ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য ছিল। তবে করোনাকালে এক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পডছে, সমাজে দুই ধরনের শিশুশ্রমের ঘঁনাই বেড়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষায় (সিএলএস) দেখা যায়, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ৫-১৭ বছর বয়সি শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৭৬ লাখ থেকে কমে ৩৫ লাখে নেমে আসে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ছিল ৩২ লাখ, যা ২০১৩ সালে ১৭ লাখ ৭০ হাজাওে নেমে আসে। ২০১৩ সালের সার্ভে অনুযায়ী অনানুষ্ঠানিক খাতে ৯৫ শতাংশ শিশুশ্রমিক নিযুক্ত। ২০১৮ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) অনুযায়ী ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু শ্রমে নিয়োজিত।
সমীক্ষায় দেখা যায়, শ্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি কমে যায়। শিশুশ্রমে নিযুক্ত ৬৩ শতাংশ শিশু স্কুলে যায় না। এদের মধ্যে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ কখনো স্কুলে যায়নি। ২০১৩ সালে সার্ভে মতে, ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। ২০১৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে ১০ জনের মধ্যে ৯ জন ছেলে ছিল এবং ২০১৮ সালে ১০ জনের মধ্যে ছয় জন ছেলে ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম হিসেবে নির্ধারণ করা হয় ধূলিকণা, ধোঁয়া, শব্দ বা কম্পন এবং বিপজ্জনক সরঞ্জামের ব্যবহারের মধ্যে কাজ করাকে। এছাড়া আগুনের শিখা, গ্যাস এবং প্রচণ্ড তাপ বা ঠান্ডার মধ্যে কাজ করা। ২০১০ সালে শিশুশ্রম নিরসনে সরকার একটি নীতিমালা করে। ঐ নীতিমালার আলোকে ২০১২ সালে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সেই কর্মপরিকল্পনাতে ২০১৬ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে লক্ষ্য পূরণ না হলে সময়সীমা ধরা হয় ২০২১ সালকে লক্ষ্য ধরে। কিন্তু এবারও আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
কিন্তু বিষয়টা অতীব দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশে আজ অবধি শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন আইন, নানা উদ্যোগ আর আয়োজনের পরও শিশুশ্রম যেন বেড়েই চলছে। হাজার হাজার শিশু শ্রম দিচ্ছে বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে, কলকারখানায়, ইটভাটায়, গ্যারেজে, রিকশায়, ওয়ার্কশপে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা আর দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতের জন্যই বেড়ে চলছে শিশুশ্রম। জীবিকার তাগিদে জীবনের শুরুতেই কোমলমতি শিশুরা মুখোমুখি হচ্ছে কঠিন বাস্তবতার। অথচ যে বয়সে তাদের হাতে থাকার কথা বই-খাতা-কলম, সেই বয়সেই হাতে তুলে নেয় কঠোর পরিশ্রমের হাতিয়ার। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বাড়ছে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা। পরিবারকে দু’মুঠো অন্ন আর অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে কোমলমতি শিশুদের যোগ দিতে হয় নানা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়।
শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য আইনের যথোপযুক্ত ব্যবহার করে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। অতিদরিদ্র গরিব পরিবারের সন্তানরা সর্বজনীন শিক্ষা বা বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই শিশুদের অভিভাবকরা অন্ন সংস্থানের তাগিদে তাদের সন্তানদের পাঠায় কাজ করতে। শিশুশ্রম সামাজিক শোষণের দীর্ঘস্থায়ী এক হাতিয়ার। সরকার ও ইউনিসেফসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন আপসহীনভাবে কাজ করছে শিশুশ্রম রোধ করার জন্য। তবুও রোধ করা যাচ্ছে না শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, শোষণ ইত্যাদি। ভবিষ্যৎ প্রবক্তাদের চোখে-মুখে যদি আমরা আলোর পরশ এনে দিতে চাই তাহলে সবার আগে তাদের উপযোগী পৃথিবী আমাদের গড়ে দিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বেড়ে উঠতে দিতে হবে অনুকূল এবং উপযুক্ত পরিবেশ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা সরকারের পক্ষে এককভাবে শিশুশ্রম সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। পেশাজীবী, নাগরিক সমাজ, নীতিনির্ধারক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াসই পারে অবহেলিত শিশুদের অনুকূল এবং উপযুক্ত পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে।
আন্তর্জাতিক শিশু তহবিল ইউনিসেফ এক নতুন প্রতিবেদনে বলেছে, কোভিড-১৯ সংকটের ফলে আরও লাখ লাখ শিশুকে শিশুশ্রমে ঠেলে দেয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা গত ২০ বছরের অগ্রগতির পর প্রথম শিশু শ্রম বাড়িয়ে দিতে পারে। কোভিড-১৯ ও শিশু শ্রম: সংকটের সময়, পদক্ষেপের সময়’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত শিশু শ্রম ৯ কোটি ৪০ লাখ কমেছে, কিন্তু এই অর্জন এখন ঝুঁকির মুখে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এরই মধ্যে শ্রমে থাকা শিশুদের হয়ত আরও বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে বা তাদের আরও খারাপ পরিবেশে কাজ করতে হতে পারে। তাদের মধ্যে আরও বেশি সংখ্যক শিশুকে হয়ত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হতে হবে, যা তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকির কারণ হবে।
মহামারির কারণে পারিবারিক আয়ে বিপর্যয় নেমে আসার কারণে কোনো সহায়তা না পেয়ে অনেকেই শিশু শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হবে। সংকটের সময়ে সামাজিক সুরক্ষা অপরিহার্য, যেহেতু তা সবচেয়ে বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দেয়। শিশু শ্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রশমনে শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা, ন্যায়বিচার, শ্রমবাজার এবং আন্তর্জাতিক মানবিক ও শ্রম অধিকার বিষয়ে সমন্বিতভাবে বৃহত্তর পরিসরে নীতিমালা প্রণয়ন বড় পরিবর্তন আনতে পারে। কোভিড-১৯ এর ফলে দারিদ্র্য বেড়ে গিয়ে শিশু শ্রম বাড়াবে। কারণ বেঁচে থাকার জন্য পরিবারগুলো সম্ভাব্য সকলভাবেই চেষ্টা করবে। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কিছু দেশে দারিদ্র্য ১ শতাংশ বৃদ্ধিতে শিশু শ্রম কমপক্ষে দশমিক ৭ শতাংশ বাড়তে পারে।
সংকটের সময় অনেক পরিবারই টিকে থাকার কৌশল হিসেবে শিশু শ্রমকে বেছে নেয়। দারিদ্র্য বৃদ্ধি, স্কুল বন্ধ ও সামাজিক সেবা প্রাপ্তি কমতে থাকায় অধিক সংখ্যায় শিশুদের কর্মক্ষেত্রে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। কোভিড পরবর্তী বিশ্বকে আমরা নতুনভাবে দেখতে চাই বলে আমাদের নিশ্চিত করা দরকার যে, শিশু ও তাদের পরিবারগুলো ভবিষ্যতে একই ধরনের ধাক্কা সামলে নিতে বিকল্প পথ খুঁজে নিতে পারে। মানসম্পন্ন শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা সেবাসহ আরও ভালো অর্থনৈতিক সুযোগ ইতিবাচক এই পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে।
অর্থনৈতিক মন্দায় অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতে কর্মরত ও অভিবাসী শ্রমিকদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মী ও বেকারত্ব বৃদ্ধি, জীবনমানের নিম্নমুখি অবস্থা, স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতিসহ অন্যান্য চাপ সৃষ্টি হতে পারে। চলমান মহামারীর কারণে এই অর্জন যেন নস্যাৎ না হয় তা নিশ্চিত করতে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন আমাদের আরও বেশি সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সময়োচিত এই প্রতিবেদনটি কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ প্রভাবের ওপর আলো ফেলেছে এবং আইএলও, সরকার, নিয়োগকর্তা, শ্রমিক সংগঠনসমূহ এবং অন্যান্য অংশীদারদের সামনে বর্তমান সংকট মোকাবেলার সর্বোত্তম পথ খুঁজে পেতে তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেছে।
সবচেয়ে অসহায় শিশুদের জীবন, আশা-আকাক্সক্ষা ও ভবিষ্যতের ওপর কোভিড-১৯ মহামারি বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। স্কুল বন্ধ ও পরিবারের আয় কমে যাওয়ার কারণে অনেক শিশুর জন্য শ্রমে যুক্ত হওয়া এবং বাণিজ্যিকভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে গত দুই বছরে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা যত বেশি সময় স্কুলের বাইরে থাকে তাদের আবার স্কুলে ফেরার সম্ভাবনা ততটাই কমে যায়। আমাদের এখন শিশুদের শিক্ষা ও সুরক্ষার ওপর অগ্রাধিকার দেয়া উচিত এবং মহামারির পুরো সময়জুড়েই তা অব্যাহত রাখা উচিত।
মহামারির এই সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশু শ্রম বৃদ্ধি পাওয়ার প্রমাণ ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায়। বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে স্কুল বন্ধ ছিলো দীর্ঘদিন যার কারণে বর্তমানে ১০০ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এখনো হচ্ছে। এমনকি যখন পুনরায় ক্লাস শুরু হবে তখন অনেক বাবা-মায়ের হয়ত তাদের সন্তানকে স্কুলে দেয়ার সক্ষমতা থাকবে না। ফলশ্রুতিতে আরও অনেক শিশু বঞ্চনামূলক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিতে বাধ্য হতে পারে। লিঙ্গ বৈষম্য আরও তীব্র হতে পারে। বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের কৃষি ও গৃহকর্মে বঞ্চনার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
শিশু শ্রম বৃদ্ধির ঝুঁকি মোকাবেলায় বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অধিকতর সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা, দরিদ্র পরিবারের জন্য সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ, বড়দের মানসম্মত কাজের সুযোগ বৃদ্ধি, স্কুলের বেতন বাতিলসহ শিশুদের স্কুলে ফেরা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ, শ্রম পরিদর্শন ও আইন প্রয়োগে সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়গুলোও রয়েছে।
গত বছর ঢাকায় ১৯৪ জন শ্রমজীবী শিশুর উপর পরিচালিত জরিপে অংশ নেয়া শিশুদের ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ জানিয়েছিলো, এই মহামারি শুরু হবার পর থেকে কাজ হারিয়েছে; মহামারিকালে তাদের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা ক্রেতা না থাকায় তাদের পণ্যের বিক্রি কমে গিয়েছিলো। আয় রোজগার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পেশা পরিবর্তন করেছে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু। এদের মধ্যে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিলো, যা ঢাকা শহরে দৃশ্যমান ছিলো। এই মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগে নগরে শিশুদের ৫৭ দশমিক ২ ভাগের মাসিক আয় ছিল ১-৩ হাজার টাকা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পরে সে সংখ্যাটি ৪৭ দশমিক ৭ ভাগে নেমে এসেছে। আবার ২১ দশমিক ৬ শতাংশ যারা ৩-৪ হাজার টাকা মাসে আয় করত তা নেমে এসেছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশে। শতকরা ৩০ দশমিক ৯ ভাগ শিশু বলেছে তাদের আয়ের উপর তাদের পরিবার নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন প্রণয়ন করেছে, যা ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। শ্রম আইনে ১৪ বছরের নিচে শিশু শ্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শ্রম আইনে বলা হয়েছে, ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ নয় এমন কাজ করতে পারবে। ৩৮টি সেক্টরকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কোনো শিশু শ্রমিক না থাকার কথা দাবি করলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শিশুদের শ্রম থেকে ফেরানোকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
করোনার কারণে সার্বিকভাবে শিশুরা ভিন্ন-ভিন্ন ধরণের বিপর্যয়ের সম্মুখিন হচ্ছে। প্রথমত নিন্ম ও দরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়বে। দ্বিতীয়ত পরিবারে কমে যাওয়া আয়ের যোগান দিতে গিয়ে অনেক শিশুই শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে এবং সস্তায় শ্রম বিক্রি করবে, এমনকি অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছে। তৃতীয়ত অনেক মেয়ে শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। চতুর্থত স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরের মধ্যে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
সার্বিক বিবেচনায় শ্রম, ভিক্ষাবৃত্তি, বাল্যবিবাহের কারণে শিশুরা শিক্ষার মূল স্রোতধারা থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় এসব শিশুদের বড় অংশ শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়তে পারে। এসব কারণে শিক্ষার অগ্রগতির সূচকে আমাদের দেশ পিছিয়ে পড়তে পারে, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন বিলম্বিত হতে পারে এবং শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নানাভাবে ব্যাহত হতে পারে। এখনই এদিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুকে শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার করতে এক হাজার টাকার মাসিক উপবৃত্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুকে শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহারে ৬ মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং ৪ মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ শিশুরা প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে উপবৃত্তি পাবে। উপবৃত্তির এ অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের মাধ্যমে দেওয়া হবে। এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার করা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে শুধু এই এক লাখ শিশুকে প্রত্যাহারই নয় এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সকল প্রকার শিশুশ্রম থেকে শিশুদের প্রত্যাহার করা হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমাদের লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক