মজবুত অর্থনীতির বাংলাদেশ কখনো শ্রীলংকা হবেনা । হীরেন পণ্ডিত
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে বাংলাদেশে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে-সে বিষয়কে ইঙ্গিত করে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। অনেকে বাংলাদেশের আকাশে শ্রীলংকার ছায়া দেখছেন, আবার কেউ কেউ উল্লেখ করছেন দেশ শ্রীলংকার পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, বলে বিভ্রান্তিতে আছেন। তাদের সমালেচানার জবাবে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে আমরা অন্য মেগা প্রকল্পগুলো গৃহীত হয়েছে। আর শুধু ঋণ নয়, বিদেশি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে।
তিনি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি ঋণ নিচ্ছে। তবে তা যাতে বোঝা হয়ে না ওঠে সেদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। আমাদের মূল লক্ষ্য অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সম্পদ বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করা। ২০২২ এবং ২০২৩ হবে বাংলাদেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের এক মাইলফলক বছর। আর কয়েক মাস পরেই চালু হতে যাচ্ছে বহুল আকাঙ্ষিঅবত পদ্মা সেতু। বহুমুখী সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটবে। এই সেতু জিডিপিতে ১.২ শতাংশ হারে অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের মধ্যে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতিতে সন্তোষজনক। বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত ১৩ বছরে যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে তা অর্থনীতির সামষ্টিক সূচকগুলো বিবেচনা করলেই স্পষ্ট হয়। ২০০৯ সালে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ১০২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তা ৪১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৭০২ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২,৫৯১ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের এসব অর্জন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ভাবনা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে। গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রেখে মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ফলেই আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসাবে পরিণত হয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ উল্টরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে মেট্রোরেল চালু হবে। আশা করা যায়, মেট্রোরেল রাজধানী ঢাকার পরিবহণ ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
অক্টোবরে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে চালু হবে দেশের প্রথম টানেল। এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১,২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিট আগামী বছরের শেষ নাগাদ।
বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে কখনো খেলাপি বা ডিফল্টার হয়নি, হবেও না। দেশের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত, সরকার অত্যন্ত সতর্ক। সম্প্রতি তাঁর এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী একই কথা বলেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক আশাব্যঞ্জক মাইলফলক ছুঁয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ সকল নাগরিককে বিস্তৃত টেলিযোগাযোগ সেবা (সরাসরি ঘরে ঘরে টিভি, রেডিও, টেলিমেডিসিন, শিক্ষা এবং ইন্টারনেট ব্যবহার), মাতারবাড়ি প্রকল্প দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে অবদান রাখছে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ প্রকল্প, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ চলছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, তিন ডজনেরও বেশি হাই-টেক পার্ক এবং আইটি গ্রাম নির্মাণ করা হচ্ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। গ্রামগুলোকে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে আমার গ্রাম আমার শহর। আজ আমরা এমন একটি দেশে পরিণত হয়েছি যে মাথা উঁচু করে রাখার সময় এসেছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৩,২০,০৭২টি পরিবারকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। মুজিব জন্মশতবর্ষে সরকার বছরের উপহার হিসেবে ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবারকে একটি করে বাডি দেয়া হয়েছে। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য প্রায় ১৪,৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক জনগণের দোরগোড়ায় রয়েছে। সরকার তিন কোটির বেশি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি ও উপবৃত্তি, ছয় লাখ মানুষকে বিভিন্ন ভাতা, ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ লাখ টাকার চাল, কৃষি খাতে কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান করে। কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন সরকার ১,২১,০০০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে যা দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এখন বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ এবং মাছ, মাংস, ডিম ও শাকসবজিতেও স্বয়ংসম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ জলসীমায় মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আজ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর সুফল শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘ ২০১৮ সালে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে একটি উনয়নশীল দেশে রূপান্তরের ঘোষণা দেয় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে, জাতিসংঘ বাংলাদেশকে একটি উন্নয়শীল দেশে পরিণত করার জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করেছিল। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতি। দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩১ সালে, বাংলাদেশে এমন কেউ থাকবে না যাকে অতি দরিদ্র বলা যাবে।
মাথাপিছু আয় মানব সম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিনটি সূচক উন্নয়নশীল দেশগুলির যোগ্যতা নির্ধারণ করে। এই তিনটি সূচকে বাংলাদেশ প্রায় কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করেছে। কোভিড-১৯ এর মধ্যেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২৫৫৪ অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে। যা গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, মা ও শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। নারীরা এখন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সকল স্তরে অবদান রাখছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গ্রামাঞ্চলের নারীরাও পিছিয়ে নেই। তারাও এগিয়ে চলেছেন পুরুষ মানুষের সাথে সমানতালে। এতে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী দেশের জন্য অর্জনের জন্য কয়েকটি মাইলফলক নির্ধারণ করেছেন। প্রথমটি ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প যা লক্ষ্য অর্জন করেছে তবে আরো করতে হবে, দ্বিতীয়টি ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন, তৃতীয়টি ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থটি ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যান। সকল নাগরিককে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত (এসডিজি-১ দারিদ্র্য অবসান এবং এসডিজি-২, জিরো হাঙ্গার অর্জন) একটি উন্নত বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে হবে এবং বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হবে। বাংলাদেশের সম্পদ সীমিত, ভূমির তুলনায় জনসংখ্যা বেশি। তা সত্তে¡ও বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উনয়নের রোল মডেল।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ অর্থনীতি গত বছরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখেছে। এর মানে এই দেশগুলোর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আগের বছরের তুলনায় কম। এমনকি প্রতিবেশী ভারতের মতো উচ্চ-বৃদ্ধির দেশগুলোতেও জিডিপির আকার প্রায় ৮ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ এই ধারার অন্যতম ব্যতিক্রম ছিল। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু আগের বছরের তুলনায় আকারে সঙ্কুচিত হয়নি। ২০১৯-২০ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্তে¡ও বাংলাদেশের অর্থনীতি পিছিয়ে যায়নি।
আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সংস্থার পূর্বাভাস ৭.৯ শতাংশ। রপ্তানি ও ভোগে ধারাবাহিকতা থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থনীতির পুনরুদ্ধার অব্যাহত থাকবে কি না এবং দারিদ্র্য হ্রাস পাবে তা নির্ভর করবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ব্যবসায়িদের সাহায্য করে অর্থনীতির ক্ষতি মোকাবেলার ওপর।
এটা মানতেই হবে যে বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। বর্তমান শুল্ক এবং কোটা-মুক্ত সুবিধা শুধুমাত্র ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইইউ বাজারে পাওয়া যাবে। এ কারণে আগামী পাঁচ বছরের প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিবিদরা এসডিজি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং টেকসই ট্রানজিটের জন্য পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার সাথে সমন্বয় করে শক্তিশালী ট্রানজিট কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ দিচ্ছেন। আগামী দিনে অগ্রগতির জন্য স্থানীয় বাজার ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, দুর্নীতি হ্রাস, মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
অনেকে শ্রীলংকার বর্তমান সংকটে বাংলাদেশকে সাবধান করছেন। তবে সাবধান থাকা ভালো কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে শ্রীলংকার অর্থনীতির গতি প্রকৃতি বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন। বংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনে কোন ঘাটতি নেই। আমাদের প্রধান খাদ্য আমদানী নির্ভর নয়। বংলাদেশে রপ্তানী আয় ও রেমিট্যান্সের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এখন পর্যন্ত কোন নিম্নমুখিতা দেখা যায়নি। বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৪.৪০ বিলিয়ন ডলার আর শ্রীলংকার ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম। বাংলাদেশের বিদেশী ঋণ শ্রীলংকার মতো মাথাপিছু এত বেশি নয়। বাংলাদেশের মাথপিছু ঋণের পরিমাণ ২৯২ ডলারের মতো শ্রীলংকার হলো ১৬৫০ ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপুল সম্ভাবনাময়। দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ আমাদের এই অগ্রগতিকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করেছে বটে, কিন্তু সামনের দিনগুলোতে আমাদের এগিয়ে যাওয়া চলমান থাকবে- এটাই আমাদের বিশ্বাস। এ ক্ষেত্রে শ্রীলংকার কাছ থেকে আমাদের অনেকগুলো বিষয় শেখার রয়েছে। আমরা সাধ্যের বাইরে যাবনা আমরা এমন স্বপ্ন দেখবো না। আমাদের সক্ষমতার বাইরে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে হাতে নেবে এটাই সবার প্রত্যাশা। দেশ-বিদেশে আজ যারা আমাদের অর্থনীতির অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে পাশে আছে, তাদের সহায়তার ছাতা সরে যেতে পারে। তাই সরকারকে অতীতের মতোই ভেবেচিন্তে কেবল প্রকৃত উন্নয়ন খাতে, আয়বর্ধক সম্ভাবনাময় খাতে, দারিদ্র বিমোচন খাতে হাত দিতে হবে। কখনই আমরা যেন বিপদে না পড়ি সেদিকে নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য রাখতে হবে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতে করোনার মতো আরও বড় ধাক্কা এলেও যেন আমরা এবারের মতোই সামলে উঠতে পারি সেদিকে নজর রাখতে হবে। তা হলেই দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমরা উন্নত দেশের কাতারে গিয়ে দাঁড়াতে পারব।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শ্রীলংকার সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলানো ঠিক হবে না। দুই দেশের সমাজ ও অর্থনীতি ভিন্ন। তাদের মূল্যায়ন তারা করবেন। ক্রমাগত উন্নতিতে এক যুগ আগে যে শ্রীলংকা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উঠার পথে ছিল, সেই শ্রীলঙ্কা এখন দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে এখন দেউলিয়া ঘোষণা করেছে নিজেদের। জ্বালানি তেল কিনতে না পারায় দেশটিতে এখন বিদ্যুৎ মিলছে না। গাড়ি চালানো দুষ্কর হয়ে উঠছে। কাগজের অভাবে পরীক্ষা নেয়া যাচ্ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। এই পরিস্থিতিতে জনবিক্ষোভে সরকারও পতনের দ্বারপ্রান্তে। সংকটে পড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি বাংলাদেশ থেকেও ঋণ চেয়েছে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি দেখে তাদের ঋণ না দেয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
শুধু আর্থিক সঙ্কট নয়, চীনের প্রতি অধিক নির্ভরশীলতা এবং পারিবারিক একনায়কতন্ত্রকেও দায়ী করা হচ্ছে শ্রীলংকার বর্তমান সংকটের কারণ হিসেবে। বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র রয়েছে, উন্নয়নের অর্থনীতি এগিয়ে চলছে। অর্থনৈতিক ভিত্তিও অনেক শক্ত। বাংলাদেশ এ বিষয়ে গবেষণা করছে এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির আর বাংলাদেশের অর্থনীতি এক নয়, তাই মেলানোও ঠিক হবে না। শ্রীলংকার পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় যে, মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ বেকারত্ব এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের ঘাটতি দেখা দেয়ায় অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীলংকা একযুগের বেশি সময় ধরে তাদের দেশে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেগুলো বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় ও অতিবাহুল্য বলে বিবেচিত হচ্ছে।
বর্তমানে শ্রীলংকা ৭৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে নিয়মিত হিমশিম খাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ শ্রীলংকা, যেখানে মাথাপিছু জিডিপি ৪ হাজার ডলারের বেশি। শ্রীলংকার ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গণমুখী। তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন আকর্ষণের বড় ঠিকানাও ছিল শ্রীলংকা। অথচ বছরখানেক ধরে শ্রীলংকার অর্থনীতি কঠিন সংকটে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে আমদানীকৃত পণ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনগণের জীবন বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে। কয়েক মাস ধরে খাদ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে সংকট মোকাবেলার ক্ষমতা এখন তাদেও নেই বললেই চলে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনজীবনে অভূতপূর্ব বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বিভিন্ন আইটেম কেনার জন্য লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, ফলে ক্রুদ্ধ জনতার সরকারবিরোধী সমাবেশও দিন দিন বড় হচ্ছে। শ্রীলংকান রুপির বৈদেশিক মান কিছুদিন আগেও ছিল ১ ডলারে ১৯০ রুপি, গত দুই মাসে সেটা বেড়ে ৩৬০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে। আগামী এক বছরের মধ্যে শ্রীলংকাকে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে। এর মানে শ্রীলংকা ‘আর্থিক দেউলিয়া’ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ২০০৯ সাল থেকে বৈদেশিক ঋণের অর্থে যত্রতত্র প্রকল্প গ্রহণের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে বলে মনে করছেন। শ্রীলংকা গৃহযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কারণে ভারত থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। চীনও শ্রীলংকার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বের বিবেচনায় দেশটিকে নিজেদের বলয়ে নেয়ার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কলম্বোয় সমুদ্রবন্দরের কাছে চাইনিজ সিটি নির্মাণ, জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে রাজাপাকসে বিমানবন্দর নির্মাণসহ আরো কয়েকটি প্রকল্পে সহজ শর্তে প্রকল্প ঋণ দেয়। পরবর্তী সময়ে যখন হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্পন্ন হয়, তখন দেখা যায় বন্দর ব্যবহারের যথেষ্ট চাহিদা নেই। বন্দরের আয় বাড়ায় চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত শ্রীলংকা ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটিকে চীনের কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয়। একই রকম বিপদে পড়তে হচ্ছে অন্যান্য কিছু প্রকল্প নিয়ে।
বাংলাদেশেও অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা ভবিষ্যতে শ্রীলংকার মতো বাংলাদেশেরও ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ার আশঙ্কার কারণ সৃষ্টি হয় কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা করছেন অনেকে। ২০১২ সালের ২৯ জুন যখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করলে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী পরম সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিলেন। ওই একটি সিদ্ধান্তই বিশ্বে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি ইমেজকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। আগামী ৩০ জুন পদ্মা সেতু সড়ক যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। আরো অনেক মেগা প্রকল্প রয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কার দেউলিয়াত্ব এবং অর্থনৈতিক ধস থেকে সময় থাকতে যেন আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি সে পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই তবে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যাশা বাংলাদেশ বাংলাদেশই হয়েই থাকবে শ্রীলংকা হবেনা আমাদের পায়ের নিচের মাটি এখনো শক্ত আছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক