আওয়ামী লীগের গৌরবের ৭৩ বছর: ত্যাগী নেতারাই নেতৃত্বে থাকুক । হীরেন পণ্ডিত
পশ্চাৎপদ ও ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্বে: র ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের অধিনে থাকা পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরনো ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের অসাম্প্রদায়িক একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নতুন দল গঠন করে।
গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের একেকটি সিঁড়ি বেয়ে ৭৩ বছরে পদার্পণ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২৩ জুন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই ও সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে আজকের এই অবস্থানে উপনীত হয়েছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ ৭৩ বছরে দলটি অনেক ঐতিহ্য-গৌরব স্থাপনে সক্ষম হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার সময়ই দলের অসাম্প্রদায়িক নামকরণের দাবি উঠলেও সমাজ বাস্তবতা ও তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলটি প্রতিষ্ঠার প্রায় চার বছর পর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্র্র্ দায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ নামে বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামের ব্রত নিয়ে এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ।
প্রথম সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। প্রথম কমিটিতে তিনি কারাগারে থেকেই যুগ্ম সম্পাদক পদ পান। নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন।
১৯৬৬ সালের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। হয়ে উঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলে রূপান্তরিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের শাসন-নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের সব আন্দোলন একপর্যায়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে দলটি অগ্রসর হয়। ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিপুল বিজয় ও স্বাধীনতার সংগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই গড়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ এ সংগঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয়। পাকিস্তানি শাসন আমলে এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী দীর্ঘ সময় দেশে একের পর এক আসা সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সব ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে ঐতিহ্যবাহী দলটি।
এই সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। অনেক চড়াই-উৎরাই এবং ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে। কখনও নেতৃত্ব শূন্যতা, কখনও দমন-পীড়ন, কখনও ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে দলটিকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। এই শূন্যতা থেকেই দলের মধ্যে একাধিক ভাঙন ও গ্রুপিং ও বহু ধারার বিভক্তি দেখা দেয়। এরপর দলের চরম ক্রান্তিকালে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে শক্ত হাতে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। প্রায় চার দশক ধরে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হচ্ছে। এই সময়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি চার বার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। তবে ৭৩ বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরই আওয়ামী লীগকে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে, রাজপথে, আন্দোলন-সংগ্রামে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করলেও তা বেশি দিন টেকেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পাঁচ বছর এবং বর্তমানে টানা সাড়ে ১৪ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে।
তবে ক্ষমতার টানা এক যুগের আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে মনে হয় আওয়ামী লীগ দল হিসেবে গতি কি গতি হারাচ্ছে? একসময় যে আওয়ামী লীগে ছিল জাতীয়ভাবে আলোকিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বহর, তৃণমূলে ছিল গণমুখী সৎ আদর্শিক ও অভিজ্ঞ রাজনীতির পরিক্ষিত মুখ সেখানে আজ চিত্রপট একেবারেই ভিন্ন। দল ও সরকারকে আলাদা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ কতটা সফলতা অর্জন করেছে তার বিষয়ে আলোচনার সময় এসেছে। দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা সারা দেশের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও তারা ক্ষমতায় নেই। দলের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যেমন ভূমিকা রাখতে পারছেন না, তেমন কর্মীদের জন্যও কিছু করতে পারছেন না। কর্মীরা এলে সানা দেওয়া ছাড়া তাদের কিছু দেওয়ার নেই। অনেকে ক্ষমতা দূরে থাক, সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকলেও দলের সংসদ সদস্য পদেও নেই। এটা দলের জন্য কতটা ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে তার কোনো দৃশ্যমান উদাহরণ নেই।
একটা সময় ছিল রাজনীতিতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে যারা নেতা হতেন তারাই এমপি, ক্ষমতায় গেলে তারাই মন্ত্রী হতেন। কেন্দ্র্র আর তৃণমূলের অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে সরকার গঠন হতো। দল ও সরকার আলাদা করার এক্সপেরিমেন্টাল ঘটনাচক্রে সরকার বা দল আদৌ লাভবান হয়েছে কি না এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অনেকে যেমন আজন্ম আওয়ামী লীগ করেও দলীয় ক্ষমতার স্বাদ পাননি তেমনি অনেকে হঠাৎ এসে উড়ে এসে জুড়ে বসে ষোল আনাই ভোগ করে ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছেন। এখন সাবেক আমলা, ব্যবসায়ী ও হ্রাইব্রিডদের জয়-জয়কার অনেকের সাংগঠনিক দক্ষতা-অভিজ্ঞতা থাকলেও দলে নেই, ক্ষমতায় আছেন। সমন্বয়হীনভাবে দল ও সরকার আলাদা করার এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা আওয়ামী লীগকে গণমুখী কর্মীবান্ধব সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির জায়গা থেকে গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একসময় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকও একাধিক দিনে শেষ হতো। সেসব বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত প্রস্তাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখত। সেই প্রস্তাব তৈরির জন্য মেধাবী রাজনীতিবিদরা ভূমিকা রাখতেন। আওয়ামী লীগ তখন গরিবের দল হলেও তার রাজনীতি ছিল বর্ণাঢ্য ও ঐতিহ্যের। আলোয় আলোকিত। এখন জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বর্ণিল উৎসব হলেও সেখানে কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব উঠে আসে না যা দেশের রাজনৈতিক মহলকে আকৃষ্ট করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর পরিবার-পরিজনসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুতই করা হয়নি, খুনিদের সরকার চার নেতাকে কারাগারে হত্যা করে দলের হাজার হাজার নেতাকে কারাবন্দী করেছে, নির্বাসিত করেছে, নির্দয় নির্যাতন করেছে। তবু জনগণের মাঝখান থেকে জন্ম নেওয়া আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮১ সালে দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গভীর অন্ধকার সময়ে এসে গণতন্ত্রের বাতি জ্বালিয়ে জীবনবাজি যুদ্ধ শুরু করলে আর ফিরে তাকাতে হয়নি পেছনের দিকে। আওয়ামী লীগ আবারও জনপ্রিয় শক্তিশালী দলে পরিণত হয়।
১৯৯৬ সালে প্রথম ২১ বছর পর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বুকভরা অভিমান রয়েছে। দল ক্ষমতায় এলে মহাদুঃসময়ের দুঃখী কর্মীদের খবর দল নেয় না। মন্ত্রীরা তাদের আর চেনেন না। এমপিরা তাঁদের কাছে ভিড়তে দেন না। দলীয় কোনো সুবিধা-লাভ দূরে থাক তাদের রাজনৈতিক মূল্যায়নটুকুও হয় না। ১৯৭৫ সালের পর সেই গভীর সংকটকালে যাঁরা ছাত্রলীগের রাজনীতির পতাকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উড়িয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির প্রচার চালিয়েছেন সাংগঠনিক দক্ষতা ও মেধায় দলকে উজাড় করে দিয়েছেন তাঁরা এখন মুখ দেখাতে পারেন না। দলও তাঁদের খোঁজ নেয় না। তাঁদের মূল্যায়ন হয় না। ওয়ান-ইলেভেনে যাঁরা ঝুঁকি নিয়েছেন, জেল খেটেছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তবু যাঁরা জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাড়েননি তাঁদের খবরও এখন কেউ নেয় না।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশেই প্রবেশ করেনি, অর্থনৈতিক উন্নয়নে পৃথিবীতে রোল মডেল হয়েছে। করোনাযুদ্ধে তাঁর সাফল্য দেখার মতো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শত ব্যর্থতার মধ্যেও তিনি তাঁর নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা, মেধা ও প্রজ্ঞায় সংকট মোকাবেলা করছেন। মানুষের ঘরে খাবার। খাবারের জন্য কাউকে কষ্ট করতে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্র পরিচালনায় আছে কিন্তু ক্ষমতা চিরস্থায়ী থাকবে না। বিরোধী দলের কঠিন রাজনীতি মোকাবেলা করার মতো সাংগঠনিক শক্তি ও কাঠামো কি তৈরি আছে? এ নিয়ে কি কেউ ভাবছেন? সুতরাং সময় এসেছে দলের ত্যাগী এবং পরিক্ষিত নেতাদের মূল্যায়ন করার।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক