জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা নিছক একটি হত্যাকাণ্ড ছিলো না, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট এই হত্যার মাধ্যমে দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র ও সংবিধানকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশের বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে অবৈধ সামরিক শক্তি ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং এর পর থেকে অবৈধ ও অনাচারি শাসনের ইতিহাস রচিত হতে থাকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডই ঘটেনি, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারেরই ক্ষমতাচ্যুতি হয়নি, ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে জনগণের অধিকার, সরকার পরিবর্তনে তাদের ইচ্ছে-শক্তি ও রায়কে অস্বীকার করা হয়েছিল। কার্যত, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে গণতন্ত্রকেই হত্যা করা হয়েছে।
পচাঁত্তরের পনেরই আগস্ট অভ্যুত্থান সংগঠিত করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তার সহযোগীদের হত্যা করে এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর তাদের নিজেদের ইচ্ছে মাফিক বন্দুকের ডগায় রাষ্ট্রপতি বানিয়ে, মন্ত্রীসভা গঠন করে, সরকার গঠন করে সম্পূর্ণভাবে সংবিধান-বিযুক্ত করে সুপার কনসটিটিউশানাল কর্তৃত্ব দিয়ে সমগ্র দেশকে সামরিক আইনের আওতায় আনা হয়েছিলো।
১৯৭৫ আগস্ট এর অন্যায় স্পর্ধাকে জাতিকে জোর করে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছিলো বলেই ১৫ বছর ধরে এ দেশে যথাক্রমে জেনারেল জিয়া এবং এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্র চলতে পেরেছে। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে অবৈধ বলে প্রতিরোধ করা হলে এরপর একের পর এক দুই ডজনেরও অধিক অভুত্থান প্রক্রিয়া ঘটতো না। একের পর এক এত হত্যাকাণ্ড হতো না। ১৫ বছর দেশ সামরিক শাসনের কব্জায় থাকতো না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র কয়েকদিন পর ২৮ আগস্ট দি গার্ডিয়ান লিখেছিলো পনেরই আগস্টের ঘটনার মধ্য দিয়ে যেন বাংলাদেশের জনগণ আইয়ুবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রচারণা এবং সামরিক শাসনের কালে প্রত্যাবর্তন করেছে।
পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনার কয়েক বছর পর ১৯৮২ সালের ৫ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিনেও বলা হয়, ১৫ আগস্ট অভুত্থান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার পর গণতান্ত্রিক আমলের অবসান হয়।
এদিকে, পনেরই আগস্টের অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয়েছিল তা যে সাংবিধানিক ভাবে বৈধ ছিল না খোদ সরকার প্রধান হিসাবে খন্দকার মোশতাক আহমদও তার প্রথম ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর প্রেসিডেন্ট হিসাবে অধিষ্ঠিত হন খন্দকার মোশতাক আহমদ। সামরিক আইনের জবর দখলকারী সরকার প্রধান ও প্রেসিডেন্ট হিসাবে জাতির উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনে তিনি এদিন এক ভাষণ দেন।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে এ সংক্রান্ত সংবাদ ছাপা হয়। ভাষণে মোশতাক এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পূতপবিত্র কর্তব্য সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য করুণাময়ের দোয়ার ওপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
তবে, তিনি বলেন, দেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন সর্ব মহলের কাম্য হওয়া সত্তে¡ও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে । খন্দকার মোশতাক আহমেদের এই ভাষণে অবশ্য আরো একটি দাবি করা হয়েছে, সেনাবাহিনীও এই পরিবর্তনের জন্য কাজ করেছে এবং সরকারের (তার) প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন অনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেছেন। তবে, সেনাবাহিনীর পুরো অংশ এই ষড়যন্ত্র এবং অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ছিল কিনা তা কিন্তু এখনো উদঘাটিত হয়নি।
আর বিধান অনুযায়ী পরিবর্তন সম্ভব না হওয়ার কথা বলে নিজেই নিজের সরকারকে অবৈধতার সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন।
খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন ৬ নভেম্বর, ১৯৭৫। রাষ্ট্রপতি হিসাবে ক্ষমতায় বসেন বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম। তবে, মোশতাক অথবা সায়েমের অধীনে যে সরকার ছিল, তা আদৌ বৈধ ছিল না। এরা দুজনেই ক্ষমতায় বসেছিলেন সম্পূর্ণ বেআইনি পথে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। হাইকোর্ট ২০১০ সালে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসাবে রায় দেয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে দিয়ে দেশে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলন্ঠিত করার জন্য ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকেই নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পাকিস্তানী ভাবধারায় মৌলবাদের রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে ন্যায়-অন্যায়ের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। ১৫ বছর ধরে সামরিক শাসন চলে। বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ থাকে। সাধারণ মানুষ তার মৌলিক অধিকার হারায়। ভোট-ভাতের অধিকার বন্দি হয় সেনাছাউনিতে। দেশে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের একটি প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ঘাতকরা ক্ষান্ত হয়নি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও বিকৃত করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করা হয়েছে এবং ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা যায়নি। স্বাধীনতার ঘোষকের নাম বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তে জিয়াউর রহমানের নাম প্রচার করা হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক