সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ ২১ বছর পর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের কলঙ্কিত ওই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে মদতদাতা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। কাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্র এখনো অজানা। কারা চিত্রনাট্য সাজিয়েছিল, কারা পরিকল্পনা করেছিল, কারা মঞ্চস্থ করেছিল তাদের নাম প্রকাশ্যে আসেনি। তদন্ত কমিশন হয়নি দীর্ঘ সাতচল্লিশ বছরেও। নতুন করে তদন্তের মাধ্যমে ‘মূল পরিকল্পনাকারীদের’ চিহ্নিত করার দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে শ্বেতপত্র প্রকাশেরও।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিশন গঠনের গণদাবির সঙ্গে একমত সরকারও। এই কমিশনের রূপরেখা কী হবে? এই কমিশনের কার্যাবলি কী হবে এবং এই কমিশনটা কাদের দ্বারা গঠিত হবে: এ নিয়ে পরিকল্পনা চলছে। এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আলাপ-আলোচনায় এটা স্পষ্ট, যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন শুধু তারা এ হত্যাকাÐে জড়িত নন। এর পেছনে একটা ষড়যন্ত্র আছে এবং সেই ষড়যন্ত্রকারী কারা তাদের অন্ততপক্ষে চিহ্নিত করে দেশের মানুষের কাছে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। ইতোমধ্যে কমিশন গঠন করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শেষ হলে এ কমিশন কাদের দ্বারা গঠিত হবে, এর রূপরেখা, কার্যাবলি কী হবে তা জানানো হবে।
গবেষকদের মতে, হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আংশিক বিচার হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন গঠন করে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জাতির। বুদ্ধিজীবীদেও ধারণা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। যে বিচার হয়েছে, তাও অসমাপ্ত। যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডের জড়িত ছিল তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু যারা এর পেছনে চক্রান্ত করেছে, তাদেরও বিচার হওয়া উচিত।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রথম তদন্ত কমিশন গঠন। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায় প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয় যুক্তরাজ্যে, ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। এর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের একটি কমিটির কক্ষে। ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ স্যার টমাস উইলিয়ামসের নেতৃত্বে কমিশনে আরো ছিলেন আয়ারল্যান্ড সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড, ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ জেফরি টমাস এবং ব্রিটিশ আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও পরিবেশবাদী আইনবিদ অবরি রোজ। তবে অনুসন্ধানের কাজে এ কমিশনকে বাংলাদেশে ভিসা দেয়নি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধানে কমিশনের কাছে আবেদন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, জাতীয় চার নেতার অন্যতম সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর বড় ছেলে প্রয়াত মোহাম্মদ সেলিম এবং আরেক জাতীয় নেতা এবং সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
কমিশনের ‘শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি : প্রিলিমিনারি’ প্রতিবেদনে লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ এবং মেজর শরিফুল হক ডালিমকে সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এ হত্যাকাণ্ডের বিচারে পদে পদে বাধা আসে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। তবে ২০০০ সালে হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন এবং পরের বছর হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে অন্য তিনজনকে খালাস দেন। কিন্তু পরবর্তী ছয় বছর মামলার শুনানি না হওয়ায় ওই রায় কার্যকর হয়নি।
২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর চ‚ড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টেও দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।
প্রয়োজন শ্বেতপত্র প্রকাশ : বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার হলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। যারা ওই হত্যাকাণ্ডে মদত দিয়েছিল, তারা এখনো ষড়যন্ত্র করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধেও চেতনায় ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশকে গড়ে তোলার জন্য তাদের চিহ্নিত করা দরকার। নতুন করে তদন্ত শেষে একটি ‘ ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশের দাবি তাদের। শ্বেতপত্র প্রকাশ কেন জরুরি: বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদরা বলেন, ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে হত্যা করতে চেয়েছে। বিচার যথেষ্ট নয়, ষড়যন্ত্রে কারা মদত দিয়েছে, কারা পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল, তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ দরকার। দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচনে শ্বেতপত্র প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করা জরুরি। হত্যাকাণ্ডের শ্বেতপত্র প্রকাশ হলে কে দায়ী, কে দায়ী নয় আর বলা যাবে না। অন্যদিকে জাতির সামনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সব ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হবে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষে গত দশ বছর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের র তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন ড. মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেন এখনো তদন্ত কমিশন করে ষড়যন্ত্রের দিক উন্মোচন করা সম্ভব। কারা পরিকল্পনা করেছে, কারা জড়িত, তা বের করা প্রয়োজন। এরপর আর সম্ভব হবে না, কারণ প্রত্যক্ষদর্শীরা বেঁচে থাকবেন না।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক