মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র: কুমিল্লার বার্ড থেকে ঢাকার আগামসি লেন – হীরেন পণ্ডিত

পর্ব-৬

0

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করতে দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্রকে এক করে জালটি বিছানো হয়েছে কুমিল্লার বার্ড থেকে। সেখানে ষড়যন্ত্রকারীরা একাধিক বৈঠক করেছে। ঢাকার আগামসি লেন হয়ে সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দু’টি ইউনিটের সেনা কর্মকর্তারা।

কয়েকমাস ধরে কয়েকজন রাজনীতিক এবং সেনা কর্মকর্তা কুমিল্লা এবং খন্দকার মোশতাকের আগামসি লেনের বাড়িতে বসে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে যাওয়ার কাজ করে গেলেও ডিজিএফআই একবার শুধু রাষ্ট্রপতিকে কয়েক সেনা কর্মকর্তার ষড়যন্ত্রের আভাস দিয়েছিলো। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, চাকুরিচ্যুত এবং চাকুরিরত ওই সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী বা অন্য কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারে কুমিল্লা ষড়যন্ত্র বিষয়ে ৪৩ নম্বর সাক্ষী হিসেবে আলোকপাত করেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক অধ্যাপক খুরশিদ আলম। প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি জানান, শিক্ষাজীবনেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন তিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কুমিল্লার বুড়িচং এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমএনএ নির্বাচিত হন।

কুমিল্লা বার্ডের ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয় দিতে গিয়ে শীর্ষে তিনি খন্দকার মোশতাকের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার চেষ্টা চালিয়েছিলো। তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখন থেকেই খন্দকার মোশতাকের সচিব হিসেবে কাজ করছিলো আরেক ষড়যন্ত্রকারী মাহবুবুল আলম চাষী। পরে খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান অধ্যাপক খুরশিদ আলম।

জাতির জনক হত্যার মূল ষড়যন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, বন্যায় অনেক খাদ্য শস্য বিনষ্ট হয়। তখন কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) বন্যা উত্তর কর্মসূচি নেয়। ওই বার্ডের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলো মাহবুবুল আলম চাষী। খন্দকার মোশতাকই তাকে এই পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলো।

সেই বন্যা উত্তর কর্মসূচি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলো। কর্মসূচিটি পরে স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি হিসেবে চালু হয়। বৈঠকগুলো হতো বার্ডে। ওই বৈঠকগুলোকে কিভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের উপলক্ষ করা হতো সেটা অবশ্য তখন তিনি বুঝতে পারেননি, যখন বুঝতে পারেন তখন ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাÐ ঘটে গেছে।

অধ্যাপক খুরশিদ আলম জানান, ১৯৭৫ সালের মার্চেও শেষদিকে খন্দকার মোশতাক ও মাহবুব আলম চাষীর উদ্যোগে বার্ডে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্মেলন হয়। তিনদিন ধরে সেই সম্মেলন চলে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিকেলে বার্ডের রেস্টহাউসে বসে তিনি তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং দু’জন এমপিসহ চা পান করছিলেন। এমন সময় একটি আর্মি জিপে সিভিল ড্রেসে খন্দকার মোশতাকের আত্মীয় মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ এবং আরো একজন সেনা কর্মকর্তা আসে। অন্যদের সেখানে রেখে দু’সেনা কর্মকর্তা এবং মাহবুবুল আলম চাষীসহ তাহেরউদ্দিন ঠাকুর রেস্টহাউসে খন্দকার মোশতাকের কক্ষে যায়। ত্রিশ থেকে ৪০ মিনিট ধরে মোশতাকের কক্ষে রাজনীতিক মোশতাক ও ঠাকুর, আমলা চাষী এবং সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক চলে। সন্ধ্যার আগে সেনা কর্মকর্তারা চলে যায় বলে অধ্যাপক খুরশিদ আলম জানান।

এভাবে রাজনীতিক-আমলা-সেনা চক্রের মধ্যে আরো বৈঠকের কথা জানিয়ে খুরশিদ আলম জানান, ১৯৭৫ এর মে-জুনে খন্দকার মুশতাকের গ্রামে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় মোশতাকের আমন্ত্রণে শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী, চিফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, আলী আশরাফ এমপি এবং তিনি উপস্থিত ছিলেন। খেলাশেষে তারা মোশতাকের বাড়িতে চা-চক্রে যোগ দেন। চা-পানের সময় বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নীতি এবং কর্মসূচির সমালোচনা করতে থাকে খন্দকার মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং শাহ মোয়াজ্জেম। ‘সেই সমালোচনায় শাহ মোয়াজ্জেমকে অত্যন্ত উৎসাহী এবং সোচ্চার দেখা যায়,’ বলে জানান খুরশিদ আলম।

এছাড়াও বিভিন্ন সময় খন্দকার মুশতাককে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পলিসির ব্যাপারে বিদ্বেষমূলকভাবে কটাক্ষ করতে দেখা যায় বলে এই সাক্ষী জানিয়েছেন। পাশাপাশি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বৈঠক চলতে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন ১৯৭৫ এর জুন-জুলাই মাসে দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সম্মেলন হয়। সেই সম্মেলনে খন্দকার মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে খুরশিদ আলম উপস্থিত ছিলেন। আলী আশরাফ এমপিও ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, পরে মাহবুব আলম চাষী যোগ দেয়।

‘সেই সম্মেলন চলাকালে আর্মির জিপে মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার এবং আরো কয়েকজন সামরিক অফিসার আসে। সম্মেলন শেষে খুরশিদ আলম কুমিল্লা চলে গেলেও চাষী, রশিদ, ফারুক এবং শাহরিয়ার খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে মোশতাকের বাড়িতে যায়।’

তিনি জানান, যে সামরিক কর্মকর্তারা মোশতাক-ঠাকুর-চাষীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে, তাদেরকেই পরে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি হিসেবে তিনি দেখতে পান। বঙ্গবন্ধু সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও একইরকম বক্তব্য এসেছে।

তার স্বীকারোক্তির শুরুটা এরকম, ১৯৭৪ সালের বন্যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে কৃত্রিম খাদ্য সংকটের কারণে অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হলে সদ্য স্বাধীন দেশটির সামগ্রিক পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে কিছু রাজনীদিবিদ এবং সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য একযোগে একটি পরিকল্পনা আঁটে। ১৯৭৫ সালে শাসনতন্ত্র সংশোধন করে বাকশাল গঠন, গভর্নর পদ্ধতি চালু এবং অন্যান্য কারণে কিছু চাকুরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তার মধ্যে হতাশা বিরাজ করছিলো।

এরপর তার স্বীকারেক্তিতেও বার্ডের সেই সম্মেলনে মেজর রশিদের সঙ্গে, পরিবার পরিকল্পনা সম্মেলনে মেজর রশিদ, মেজর বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার ও মেজর ফারুকের সঙ্গে এবং ফুটবল ম্যাচের পর সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মোশতাকের বৈঠকের কথা এসেছে।

এর বাইরে ঠাকুরের জবানবন্দিতে আছে ১৯৭৫ এর মে বা জুন মাসে ঢাকার গাজীপুরের সালনায় শাপলা হাইস্কুলে ঢাকা বিভাগীয় স্বনির্ভর সম্মেলন হয়। সেখানেও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা উপস্থিত হয়। তাদের মধ্যে মেজর নূর, মেজর শাহরিয়ার এবং মেজর ফারুক ছিলো। সেখানে মোশতাক সেনা অফিসারদের জিজ্ঞেস করে, তোমাদের আন্দোলনের কি অবস্থা? জবাবে তারা বলে, বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা তার প্রতিনিধি।

ঠাকুর একথাও জানিয়েছে, আইয়ুব আমলের দুই জেনারেল এম আই করিম এবং চৌধুরীর সঙ্গে মোশতাকের ঘনিষ্ঠতা ছিলো। তারা বেশ কয়েকবার গুলশানের বাসায় আসা-যাওয়া করেছেন। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় এই দু’জনের নাম আর তেমনভাবে কোথাও আসেনি।

মুশতাকের বিষয়ে ঠাকুর এছাড়াও জানিয়েছে, ১৯৭৫ এর আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গভর্নর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খন্দকার মোশতাক উপস্থিত ছিলো। ঢাকা ফেরার পথে মোশতাক হাসতে হাসতে গভর্নর আলী আলমকে বলে, গভর্নর তো হয়েছেন, কাজ শুরু করতে পারবেন তো?

তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের জবানবন্দিতে এরপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাতের কথা বলা হয়েছে। বর্ণনাটা এরকম ১৩ আগস্ট অনুমান বিকেল ৩টায় শেখ মুজিবুর রহমানের তলবমতে গণভবনে যাই। বঙ্গবন্ধু আমাকে পেছনে ডেকে নিয়ে বলেন, তোর ওপর খুব অবিচার হয়েছে। এটা ঠিক হচ্ছে না।

খন্দকার মোশতাককে একথা জানানোর পর মোশতাক বলে, তা হলেতো ভালোই। তোমার পদোন্নতি হচ্ছে। অপেক্ষা করো, কখন কী হয়। মোশতাক অবশ্য সেসময় কোনোকিছুর ইঙ্গিত দিয়ে তাকে আপাততঃ ঢাকার বাইওে যেতে নিষেধ করে, পরদিন তার অফিসে দেখা করতে বলে।

জবানবন্দি অনুযায়ী, পরদিন মোশতাকের সঙ্গে দেখা হলে ঠাকুরকে মোশতাক বলে, এ সপ্তাহে জিয়া দুইবার এসেছিলো। সে এবং তার লোকেরা তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। ঠাকুরের প্রশ্নের উত্তওে মোশতাক জানায়, জোরপূর্বক ক্ষমতা বদলাতে চায়। প্রয়োজনবোধে যে কোনো কাজ করতে প্রস্তুত।

ঠাকুরের আরো প্রশ্নে মোশতাক তার মতামত দিয়েছে বলে ঠাকুরের স্বীকারোক্তিতে আছে। কারণ হিসেবে মোশতাক তাকে বলেছিলো, এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। মোশতাক সেসময় ঠাকুরকে তার সঙ্গে থাকতে এবং ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে পরামর্শ দেয় বলে জানিয়েছে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। পরদিন মেজর ডালিমের ঘোষণায় ঠাকুর বুঝতে পারে, এতোদিন যে অফিসাররা খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলো তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে।

মোশতাকের সঙ্গে যে খুনি সেনা কর্মকর্তাদের বেশ আগে থেকেই যোগাযোগ ছিলো সেটা মেজর ফারুকের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও পাওয়া যায়। তার জবানবন্দিটা এরকম: মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ পরিকল্পনা মোতাবেক পলিটিক্যাল যোগাযোগ হিসেবে তার আত্মীয় তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে মেজর রশিদ ও ডালিম আলোচনা করে যে, বাকশালের পতন ঘটাতে হবে এবং প্রয়োজনে শেখ মুজিবকে হত্যা করতে হবে; নইলে দেশ বাঁচবে না। মেজর ফারুকও এ ধারণাকে সমর্থন করে।

ফারুক স্বীকার করেছে, খন্দকার রশিদ জানায় যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারলে জিয়াও তাদেরকে সমর্থন দেবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে রশিদের সঙ্গে মোশতাকের সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিলো ১৪ আগস্ট।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে খন্দকার মোশতাক এবং মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদের মধ্যে ১৪ আগস্টের বৈঠকের বর্ণনা দিয়েছে মৃত্যুদÐে দÐিত খুনিদের একজন মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান। ওসনাবাহিনী থেকে আগেই অবসরে যাওয়া শাহরিয়ার ওইদিন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছিলো। বিকেলে রশিদ এবং মেজর নূর তাকে মন্ত্রী খন্দকার মুশতাকের আগামসি লেনের বাসায় নিয়ে যায়। যাবার পথে তারা গাড়ি রেখে যায় চানখারপুলে। সেখানে তাদের মধ্যে এমন আলোচনা হয় যাতে পরদিন সকালে তার বাসায়ই অবস্থান করে খন্দকার মোশতাক।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.