শেখ হাসিনা’র ক্লাইমেট মবিলিটি অ্যাওয়ার্ড অর্জন

0

হীরেন পণ্ডিত : এ বছরের ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস ২৮’ সংক্ষেপে ‘কপ২৮’। সম্মেলনে এবার অংশ নিয়েছেন ১৯৮টি দেশের শীর্ষ নেতারাসহ প্রায় ৭০ হাজার
অংশগ্রহণকারী, যার মধ্যে ১৪০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরাও ছিলেন।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অত্যন্ত বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম অবস্থানে থাকায় এই সম্মেলনে এ দেশের প্রতিনিধিরা কার্যকর ভূমিকা পালন করে এ দেশসহ সারা পৃথিবীর জলবায়ু প্রশমন ও অভিযোজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন, জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল ও প্রযুক্তি সহায়তাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করবেন।

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশকে উন্নত দেশগুলোর প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করতে হবে। সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ), স্বল্পোন্নত দেশের তহবিল (এলডিসিএফ), অভিযোজন তহবিল (এএফ) এবং জিইএফ ট্রাস্ট তহবিলকে পর্যাপ্ত অর্থসংস্থান দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে এবং সেই তহবিলের প্রবেশাধিকার দ্রুত ও সহজ করতে হবে।

বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছে, তা অর্জন করার জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজ করতে হবে। জলবায়ু বিষয়ে কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বের কণ্ঠস্বর হিসেবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিযুক্ত মানুষের
পক্ষে বিশ্বব্যাপী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ক্লাইমেট মোবিলিটি চ্যাম্পিয়ন লিডার অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করা হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এবং জাতিসংঘ সমর্থিত গ্লোবাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট মোবিলিটি সংস্থা এই পুরস্কার প্রদান করেছে। দুবাইয়ে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন-কপ ২৮ এর সাইডলাইনে একটি উচ্চ-স্তরের প্যানেল অধিবেশনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি রাষ্ট্রদূত ডেনিস ফ্রান্সিস এবং আইওএমের মহাপরিচালক অ্যামি পোপের কাছ থেকে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে পুরস্কারটি নেন।

কপ-২৮ এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের প্রধান তথ্যমন্ত্রী ও পরিবেশবিদ ড. হাছান মাহমুদ এ সময় ‘অভিযোজন এবং সহনশীলতার জন্য জলবায়ু গতিশীলতাকে আয়ত্তে আনা’ শীর্ষক উচ্চ-স্তরের এ প্যানেল অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। জলবায়ু গতিশীলতার বিষয়টিকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আলোচনার মূলধারায় আনার এখনই উপযুক্ত সময় উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের ক্লাইমেট মোবিলিটি সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ুজনিত কারণে বাধ্য হয়ে অভিবাসন এবং বাস্তচ্যুতির দিকটি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিয়ে আসেন।’ এর আগেও বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় আইওএমের সহযোগিতায় আয়োজিত দু’টি সংলাপ এবং গত বছর মিসরের শার্ম এল শেখে কপ ২৭ এ বিষয়টি তুলে ধরেছে বলে জানান হাছান মাহমুদ।
একই সঙ্গে কক্সবাজারে বাস্তুচ্যুত ৪ হাজার ৪০০ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম বহুতল সামাজিক আবাসন প্রকল্প নির্মাণসহ জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উদ্যোগের নানা দিক তুলে ধরেন তিনি।

‘ক্লাইমেট মোবিলিটি চ্যাম্পিয়ন লিডার অ্যাওয়ার্ড প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং জলবায়ু গতিশীলতা এবং
এ থেকে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের ক্রমাগত নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বের সমর্থন।’ বাংলাদেশ সন্তুষ্ট যে, এখন জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর একটি বিস্তৃত জোট এই ইস্যুতে একযোগে কাজ করছে।’ পুরস্কার দেওয়া গ্লোবাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট মোবিলিটি সংস্থাটি জাতিসংঘ, আঞ্চলিক আন্তঃসরকারি সংস্থা এবং উন্নয়ন অর্থ সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতায় জলবায়ু গতিশীলতা মোকাবিলায় সহযোগিতামূলক বিস্তৃত সমাধানের জন্য কাজে ব্যাপৃত।

জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সংকট। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব; যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো এবং জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা প্রভৃতির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই জলবায়ু পরিবর্তন দেশের কৃষি, অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। কপ২৮ সম্মেলন এই বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। এবারের এই সম্মেলনে বরাবরের মতো এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করা ১৯৮টি দেশের শীর্ষ নেতারা একত্র হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো মোকাবেলা করতে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্দেশ্যে কথা বলেন।

জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই কনভেনশনের অংশ হিসেবে বরাবরই এই সম্মেলনে মিলিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের অগ্রভাগে থাকা বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এই বছরের জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। চলতি বছরের সম্মেলনে বাংলাদেশ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

বৈশ্বিক স্টক-বাংলাদেশের এজেন্ডার প্রথম ইস্যুটি ‘প্রথম বৈশ্বিক স্টকটেক’ সম্পর্কিত, যা এই বছরের জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বৈশ্বিক মজুদ হলো দেশ এবং অংশীদারদের জন্য একটি প্রক্রিয়া, যেখানে তারা প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তির লক্ষ্য পূরণের দিকে সম্মিলিতভাবে কোথায় অগ্রগতি করছে এবং কোথায় নেই, তা দেখার জন্য। লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল : লস অ্যান্ড ড্যামেজ
শব্দটি বোঝায় যে দেশগুলো, বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো জলবায়ু সংকটের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে- তারা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

জাতিসংঘ এটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছে : ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে উদ্ভূত ক্ষতি ও ক্ষতির মধ্যে চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, সমুদ্রের অ্যাসিডিফিকেশন, হিমবাহ পশ্চাদপসরণ এবং সম্পর্কিত প্রভাব, লবণাক্ততা, ভূমি ও বন অবক্ষয়, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং মরুকরণের মতো ধীরগতির ঘটনাগুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।’ অভিযোজনে বৈশ্বিক লক্ষ্য : গ্লোবাল গোল অন অ্যাডাপ্টেশন জিজিএ প্যারিস চুক্তির ৭.১ অনুচ্ছেদের অধীনে একটি সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি, যার লক্ষ্য ‘বিশ্বের অভিযোজিত ক্ষমতা বৃদ্ধি, স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাস করা।’ জিজিএর উদ্দেশ্য হলো একটি ঐক্যবদ্ধ কাঠামো হিসেবে কাজ করা, যা প্রশমনের মতো একই মাত্রায়
অভিযোজনের জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং অর্থ পরিচালনা করতে পারে।

এই বছরের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ ‘বৈশ্বিক অভিযোজন লক্ষ্য’-এর কাঠামো তৈরি ও প্রণয়নে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করতে চায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ সদস্য দেশগুলোকে তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানে (এনডিসি) বর্ণিত ২০৩০ সালের প্রশমন লক্ষ্যগুলো ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে এবং এলডিসি দেশগুলোতে তহবিল বাড়ানোর জন্য জোর দেবে।

জলবায়ু অর্থায়নে ১০০ বিলিয়ন ডলার : ঢাকার আলোচ্যসূচির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জলবায়ু অর্থায়ন। জাতিসংঘের মতে, জলবায়ু অর্থায়ন বলতে স্থানীয়, জাতীয় বা আন্তঃদেশীয় অর্থায়নকে বোঝায়। সরকারি, বেসরকারি এবং অর্থায়নের বিকল্প উৎস থেকে নেওয়া, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করবে এমন প্রশমন এবং অভিযোজন পদক্ষেপকে সমর্থন করতে চায়।

অভিযোজন তহবিল দ্বিগুণ করা : এই বছরের জলবায়ু সম্মেলনের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা হলো অভিযোজন তহবিল দ্বিগুণ করা। অভিযোজন তহবিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্বল সম্প্রদায়গুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করে এমন প্রকল্প এবং কর্মসূচিকে অর্থায়ন করে। দেশের চাহিদা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং অগ্রাধিকারের ওপর ভিত্তি করে উদ্যোগ নেওয়া হয়। কপ২৮-এর প্রথম দিনই লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলের বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়েছে।

প্রথমে বিশ্বব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি তহবিল গঠন করা হবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থ বিতরণ করতে সক্ষম হবে এবং ধনী শিল্পোন্নত দেশ, উদীয়মান অর্থনীতি এবং জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ; যেমন- চীন, উপসাগরীয় দেশ এবং কপ২৮ আয়োজক
দেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত দ্বারা অর্থায়ন করা হবে। কপ২৮ জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, মানবতার ইতিহাসে ২০২৩ সালই হতে চলেছে এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বিশ্বনেতাদের জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে কাজ করার
জন্য মিনতি করে গুতেরেস বলেন, ‘আমরা জলবায়ু ভেঙে পড়ার বাস্তব চিত্র চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।’ কপ২৮ সম্মেলনে একটি নতুন গবেষণাপত্রের ফল উঠে এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে জলবায়ু জরুরি অবস্থার তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে।

অ্যাডভান্সেস ইন অ্যাটমস্ফিয়ারিক সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় এটি উল্লেখ করেছে যে এশিয়ার বৃহৎ অংশ এবং আমেরিকা মহাদেশের বেশির ভাগ অংশ একটি ব্যতিক্রমী উষ্ণ শীত অনুভব করতে পারে এবং এটি ৯৫ শতাংশ সম্ভাবনা দেয় যে ২০২৩-২৪ শীতের জন্য বিশ্বব্যাপী গড় পৃষ্ঠের তাপমাত্রা একটি নতুন ঐতিহাসিক রেকর্ড স্থাপন করবে।

জার্মান ওয়াচের তথ্য মতে, বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত বছরগুলো থেকে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে; যেমন- ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টি, বন্যার প্রকোপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোনের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি, অকাল খরা ইত্যাদি। তবে উপকূলীয় অঞ্চলের একটি প্রধান সমস্যা হলো মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের বিরূপ আচরণের প্রভাবে এই লবণাক্ততা দিন দিন অনেক বেড়ে যাচ্ছে এবং ফলে সেখানে সুপেয় পানির অভাব, খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি, মানুষের বাস্তচ্যুতি, কাজের অভাব ইত্যাদি আরো প্রকট হচ্ছে। একই সঙ্গে ঘন ঘন সাইক্লোন ও বন্যার জন্য আমরা বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছি।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ জলবায়ু ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর প্রায় পাঁচ-ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বার্ষিক বাজেট থেকে খরচ করছে। অথচ আন্তর্জাতিক পরিম-ল থেকে বছরে মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের মতো সহযোগিতা আসছে। সে ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কয়েক গুণ বেশি অর্থের প্রয়োজন, যে পরিমাণ অর্থ আন্তর্জাতিক পরিম-ল থেকে পাওয়ার জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে। শুধু তা-ই নয় বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছে, তা অর্জন করার জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজ করতে হবে।

জলবায়ু বাস্তচ্যুতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্ধসঢ়;বান জানান এবং ভবিষ্যৎ মানবসংকটের মুখোমুখি হওয়া থেকে তাদের রক্ষায় মানবগতিশীলতার কয়েকটি বিষয়ের ওপর আমাদের নজর দেওয়া দরকার। বেশির ভাগ জলবায়ু স্থানচ্যুতি জাতীয় সীমানার মধ্যে এবং কিছু ভয়ানক পরিস্থিতিতে সীমান্তের ওপারে ঘটে। এ ধরনের পরিস্থিতি যাতে মানবিক সংকটে পরিণত না হয়, সে জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সংহতি প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যাঁরা বাস্তুচ্যুত বা আটকে পড়েছেন, তাঁদের মৌলিক পরিষেবা, সামাজিক সুরক্ষা ও জীবিকার বিকল্পগুলোয় প্রবেশাধিকার থাকা দরকার। তাঁদের আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের ওপর বিরূপ প্রভাবগুলোও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতিতে মোকাবিলা করা দরকার।

এটি অনুমান করা হয়েছে যে জলবায়ু পরিবর্তন ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২১ কোটি ৬০ লোককে বাস্তুচ্যুত করতে পারে, এর মধ্যে ৪ কোটি এককভাবে দক্ষিণ এশিয়ার। বাংলাদেশে আমাদের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, ঘন ঘন বন্যা ও প্রবল ঘূর্ণিঝড় তাঁদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কওে তোলে। এ ধরনের স্থানচ্যুতি আমরা যা ভাবি, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে ঘটছে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে এখন মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আগত ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এই লোকদের মধ্যে কিছু লোক পাচার নেটওয়ার্কের শিকার হয়, যার সঙ্গে সমগ্র অঞ্চলের নিরাপত্তাঝুঁকি রয়েছে। এ ধরনের মিশ্র অভিবাসনপ্রবাহ জলবায়ু গতিশীলতার সমস্যাটিকে আরও বেশি সমস্যাযুক্ত করে তোলে।’ বাংলাদেশ বিশ্বাস করে যে মানবগতিশীলতার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
আন্তর্জাতিক আলোচ্যসূচিতে উচ্চস্থান দেওয়া উচিত।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বিষয়টির কার্যকর সমাধানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে আইওএম এবং অন্য অংশীদারদের সঙ্গে একত্রে কাজ করছে। আমাদের নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত অভিবাসনের জন্য গ্লোবাল কমপ্যাক্টের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অধিকারভিত্তিক পদ্ধতিতে মানবগতিশীলতার ওপর জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে। জলবায়ু– অভিবাসীদের অভিঘাত ও ক্ষতির প্রসঙ্গে নির্দিষ্ট সমাধান খুঁজে বের করার জন্য জলবায়ু ন্যায্যতার আলোকে পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে।

অভিবাসনকে জলবায়ু অভিযোজন কৌশল হিসেবে দেখার জন্য স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রস্তুত হতে হবে, যেখানে এটি সর্বোত্তম সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে প্রমাণিত হবে। জলবায়ু–অভিবাসী, বিশেষ করে নারী, শিশু ও অন্য ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর পুনরুদ্ধারের জন্য বিদ্যমান আন্তর্জাতিক সুরক্ষামান পর্যালোচনা করতে হবে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে এটির জন্য একটি গঠনমূলক অবস্থান তৈরিতে
মানবগতিশীলতার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়ে উন্নত গবেষণা ডেটা এবং প্রমাণের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করা উচিত।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.