শিল্পী বারী সিদ্দিকীর স্বপ্নের বাউলবাড়ি
হীরেন পণ্ডিত : নকলের দাপটে, হাইব্রীডদের করণে গুণীরা হারিয়ে যাচ্ছে, আমাদের এই সমাজ থেকে, দেশ থেকে। সেটা শিল্প সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজনীতি প্রায় সবক্ষেত্রেই। গুণী মানুষদের যদি মূল্যায়ন করা না হয়, মেধার মূল্যায়ন করা না হয় তবে সমাজ পেছনে পড়ে যাবে। তবে সরকার প্রশংসার দাবি রাখে নেত্রকোণার বিশিষ্ট একজন বাউল কবি ও গায়ক জালাল উদ্দিন খাঁ (১৮৯৪-১৯৭২) এঁর কথা ৫২ বছর মনে করতে পেরেছেন এই ভেবে।
শিল্পকলায় (সংগীত) অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০২৪ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। মৃত্যুর ৫২বছর পর একুশে পদক পেলেন নেত্রকোণার বাউল সাধক জালাল উদ্দীন খাঁ। বারী সিদ্দিকী পৃথিবী ছেড়েছেন ৫ বছর হলো, আমরা জানিনা তাঁর কত বছর লাগবে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন পেতে। অপেক্ষা করে দেখি!
বারী সিদ্দিকী, বারী ভাইকে দেখি ১৯৮৬ সালে সূর্যসেন হলের নিচতলার তাঁর নিজের কক্ষে। আমাদের এলাকার বড় ভাই শরীফ উদ্দিন আহমেদের সাথে তাঁর রুমে গিয়ে। রুমে গিয়ে দেখি তিনি আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছেন। এখানে উল্লেখ্য, নেত্রকোণা থেকে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে প্রথম কিছুদিন সূর্যসেন হলের এলাকার বড় ভাইদের কাছে থেকে কিছুদিন পর নিজ হল জগন্নাথ হলে চলে যাই। ততদিনে বারী ভাইও পাশ করে হল ত্যাগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার পর তিনি চলে যান ভারতের পুনেতে সংগীত ও বাঁশীতে উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার জন্য।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত বংশীবাদক ও সংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বাউলগানের পাশাপাশি উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নেন ভারতে। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি উকিল মুন্সি, জালাল উদ্দীন খাঁর গান সংগ্রহ করেন এবং গাইতে শুরু করেন। এ ছাড়া শ্রদ্ধেয় গীতিকার শহীদুল্লাহ্ ফরাজির লেখা এবং তাঁর নিজের লেখা গান সুর করে ও গেয়ে জনপ্রিয়তা পান। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে মনে করা হয় তাঁকে।
বারী সিদ্দিকী ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোণায় এক সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নেত্রকোণা সদর উপজেলার মৌগাতি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রাম বারী সিদ্দিকীর জন্মস্থান। বাবা প্রয়াত মহরম আলী ও মা প্রয়াত জহুর-উন-নিসা। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে বারী সিদ্দিকীই ছিলেন সবার ছোট। বারী সিদ্দিকীর পুরো নাম আবদুল বারী সিদ্দিকী। শৈশবে পরিবারের কাছে গান শেখার হাতেখড়ি। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নেত্রকোণার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের অধীনে তাঁর আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ অসংখ্য গুণীশিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন।
ওস্তাদ আমিনুর রহমান একটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় বারি সিদ্দিকীকে দেখে তাঁকে আরো প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এরপর, ছয় বছর ওস্তাদ আমিনুর রহমানের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। সত্তরের দশকে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হন বারী। এরপর, ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ধ্রুপদী সংগীতে পড়াশোনা শুরু করেন বারী সিদ্দিকী। পরবর্তী সময়ে বাঁশির প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠায় তিনি বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। দেশে ফিরে লোকগীতির সাথে ধ্রুপদী সংগীতের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন।
তাঁর শ্বশুরবাড়ি নেত্রকোণার সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নের কারলি গ্রামে। সেই সূত্রে কারলি গ্রামে শ্বশুর নূরুল হুদার বাড়ির পাশে তিনি এই বাউলবাড়ি নির্মাণ করেন। তবে সেই বাড়ির সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ অসমাপ্ত থেকে গেছে। বাংলা লোকগানের জনপ্রিয় শিল্পী বারী সিদ্দিকীর স্বপ্ন ছিল তাঁর বাউলবাড়িতে বাউলরা আসবেন, থাকবেন এবং গানের চর্চা করবেন। তাঁর এ কাজ নিজে শেষ করে যেতে না পারলেও তা এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিবিদ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। নেত্রকোণা সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নের কারলি গ্রামে প্রায় এক যুগ আগে ১২০ শতক জমিতে এই বাউলবাড়ির কাজ শুরু করেন তিনি। এখানে পুকুরের উপর ঘর, একটি মসজিদ, বাউলদের থাকার জন্য ঘর, বাড়ির সীমানাপ্রাচীর করার পরিকল্পনা থাকলেও তিনি শেষ করতে পারেননি।
আমার সাথে সবশেষ দেখা লোকসঙ্গীত শিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়ের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে। এরপর অনেকদিন দেখা নাই হঠাৎ শুনি স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি তিনি, অবস্থা ভালো নয়। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বারী সিদ্দিকী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ২৪ নভেম্বর ২০১৭। বাউলবাড়ির আঙ্গিনায়ই বারী সিদ্দিকীর কবর দেওয়া হয় তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী।
নেত্রকোণা শহরের চানখাঁর মোড় এলাকায় বাসবভন থাকলেও ঢাকা থেকে নেত্রকোণায় আসলে এই বাউল বাড়িতেই থাকতেন বারী সিদ্দিকী। মৃত্যুর চার মাস আগে বারী সিদ্দিকী সর্বশেষ বাউলবাড়িতে গিয়েছিলেন। বারী সিদ্দিকী স্বপ্ন দেখতেন এই বাড়িটিতে বাউলেরা আসবেন, থাকবেন, গানের চর্চা করবেন। তিনি পুকুরের উপর ঘর, একটি মসজিদ, বাউলদের থাকার জন্য ঘর, বাড়িটির সীমানাপ্রাচীর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা করে যেতে পারেননি।
বারী সিদ্দিকী দেশের সম্পদ। উচ্চাঙ্গ সংগীতের সাথে লোক সংগীতের মিশেলে যে ধারা করে গেছেন, তার জীবনভর সংগীত সাধনা সবকিছুই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাঁর দেখা স্বপ্নের বাউলবাড়িটির বাকি কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব এখন সংস্কৃতি কর্মী, শিল্পী সবার। সবাইকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মৃত্যুর বছর খানেক আগে বারী সিদ্দিকী এই বাড়িতে বাউলদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। গানের জলসা করেছেন। এতে অন্তত ১০০ জন বাউল যোগ দিয়েছিলেন।
তিনি বাউলবাড়ির কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। তার স্বপ্নের বাড়ি গড়ার বাকি কাজ এগিয়ে নিতে সকলের সহযোগিতা করা উচিত। আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল উপস্থিত ছিলেন বারী সিদ্দিকীকে সমাহিত করার সময় বাউলবাড়িতে। বাউলদের নিয়ে যে স্বপ্ন বারী সিদ্দিকী দেখতেন তা বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
হেমন্তের দিনে কিছুটা বিষন্ন সুর দেখা দেয় নেত্রকোণার কারলী গ্রামে। এখন আর সেখানে মোহন বাঁশি বাজে না। অথচ এ গ্রামে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেওয়া বারী সিদ্দিকী হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো বাঁশি বাজিয়ে উদ্বেলিত করতে চেয়েছিলেন তাঁর শ্রোতাদের। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তিনিও হয়ে গেছেন আসমান থেকে খসে পড়া নক্ষত্র। নেত্রকোণার আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। ছাত্র হিসেবে বারী সিদ্দিকী সব সময় ভালো ছিল। ১৯৭৯ সালে সে এসএসসি পরীক্ষা দেয়। তখন ইংরেজি বিষয়ে লেটার পেয়েছিল। তখন ঢাকা বোর্ড কর্তৃপক্ষ তার রেজাল্ট স্থগিত করেছিল। সে সময় লেটার পাওয়াটা একটা অন্য রকম ব্যাপার ছিল। খুব কঠিনও ছিল। পরে বোর্ড কর্তৃপক্ষ তার ইন্টারভিউ নিয়েছিল। মানবিক বিভাগে সে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্যও কাজ করেছেন তিনি তাঁর সঙ্গীত সাধনার মাধ্যমে।
প্রতিবছরের ১৫ নভেম্বর তাঁর জন্মদিনে বাউলবাড়িতে বাউলগানের আসর বসে। জেলা শহরসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসেন সে অনুষ্ঠানে। গান শোনেন এবং শ্রদ্ধা জানান বারী সিদ্দিকীর স্মৃতির প্রতি। আমি একটা জিন্দা লাশ, শুয়া চান পাখি, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, পূবালি বাতাসে, তুমি থাকো কারাগারে, রজনী, ওলো ভাবিজান নাউ বাইয়া, মানুষ ধরো মানুষ ভজো- প্রভৃতি গানের জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বারী সিদ্দিকী বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বংশী বাদক । গানে গানে বিরহের কথা বলে গেছেন তিনি। একস্বপ্নীল সুরের মায়ায় আবিষ্ট করে রেখেছেন লাখো দর্শক শ্রোতাকে বছরের পর বছর। ২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বারী সিদ্দিকী সশরীরে না থাকলেও তার রেখে যাওয়া মায়া জড়ানো গানে দর্শকদের মাঝে অমর হয়ে আছেন।
নব্বইয়ের দশকে কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বারী সিদ্দিকীর পরিচয়। হুমায়ূন আহমেদের নাটক-সিনেমায় গান করায় বারী সিদ্দিকীর নাম পরিচয় আরো ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন তিনি। ১৯৯৫ সালে হুমায়ূন আহমেদের ‘রঙের বাড়ই’ নামের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রথম সংগীত পরিবেশন করেন বারী সিদ্দিকী। এরপর, ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে সাতটি গানে কণ্ঠ দেন তিনি। এর মধ্যে ‘শুয়া চান পাখি’ গানটির জন্য তাঁর পরিচয় ও শ্রোতাপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। তারপর, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
১৯৯৯ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তিনি অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বারী সিদ্দিকী অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই বাঁশি বাজান বারী। তাও একটানা ৪৫ মিনিট। অসাধারণ সেই পরিবেশনায় তিনি মুগ্ধ করেন বিশ্ব শ্রোতাদের। এরপর দেশ-বিদেশের বহু অনুষ্ঠানে বাঁশির সুরে হৃদয় স্পর্শ করেছেন এই শিল্পী।
তিনি প্রবাস প্রজন্ম জাপান সম্মাননা (২০১৪), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ১৯৮০ সালে বারী সিদ্দিকী পেশাগতভাবে বাঁশি বাজানো শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম বিটিভিতে সৃজন অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজান। বারী সিদ্দিকী ‘মাটির পিঞ্জিরা’ নামের একটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। পরে তিনি ফেরারি অমিতের নির্দেশনায় ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকেও অভিনয় করেন। তবে অভিনয় করতেন নিতান্তই অনুরোধে এবং শখের বশে। তবে বারী সিদ্দিকীর মতো শিল্পীর তো রাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি প্রাপ্য ছিলো। সারাজীবন সঙ্গীত সাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন এই মহান সঙ্গীত সাধক।
বারী সিদ্দিকীর স্বপ্ন ছিল, নিজ হাতে গড়া বাসভবনের উত্তর দিকে থাকবে তার সমাধি। এর পশ্চিম দিকে থাকবে সুউচ্চ মিনারসহ একটি মসজিদ। পূর্ব দিকে থাকবে বাউল ইনস্টিটিউটসহ পার্ক এবং আগত বাউল-সাধক ও শিল্পীদের জন্য আখড়া। কিন্তু তার প্রয়াণের পর তার সব স্বপ্নেরও যেন মৃত্যু হয়েছে। অনেকেই সরকারি-বেসরকারি নানা ধরনের উদ্যোগ-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কিছুই আলোর মুখ দেখেনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছে দাবি, শিল্পীর স্বপ্নপূরণে রাষ্ট্র যেন এগিয়ে আসে।