তাক্কিন। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল বাছেত

0

তাক্কিন

অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল বাছেত
০৬-০৬-২০২১ সুজানগর, পাবনা।

সন্ধ্যায় পাবনা শহরে হাঁটছিলাম ।মহিলা কলেজ পার হয়ে রায় বাহাদুর মার্কেটের দিকে যাচ্ছে একদল যুবক।
অগ্রজের দর্শনীয় ইঙ্গিতই প্রমান করছে তিনিই নেতা। অনুগামীদের মানানসই আনুগত্য। খুব কৌতূহল জাগলো মনে তাই সবার পেছনেরটাকে খপ্ করে ধরে জিজ্ঞেস করলাম – ভাই, তোমারা যাচ্ছো কোথায়?
: তাক্কিন।
কোন সংগঠনের শোডাউন?
: তাক্কিন।
: নেতার নাম কি?
:আবারও উত্তর
: তাক্কিন।
আশ্চর্য কথা! এবার কি জিজ্ঞেস করবো ভাবছি কিন্তু ঐ তরুনই আমাকে প্রশ্ন করলো –
আপনি এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? কি দরকার ? আপনি কে?
আমি উত্তর খুঁজছি কিন্তু আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।
: তাক্কিন ।
অতঃপর তরুনদের মৌন পদযাত্রা সকল পথিকের দৃষ্টি আকর্ষন করছে কিন্তু আমি স্তম্ভিত!
ঘটনাটি সহজ কিন্তু রাতে সহজে ঘুমাতে পারলাম না। এই তরুনেরা
আমার দেশের মোট জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ। গৃহিনীরা বলেন ‘ পাতিলের একটা ভাত টিপলেই চালের অবস্থা বুঝা যায় ‘ – এরকম ভাবতে চাই না কিন্তু সাম্প্রতিকে এই যুবশ্রেনীর চিন্তা-চেতনা , শিক্ষা-দীক্ষা, মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার নিয়ে
শংকিত হবার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। তাদের পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক শিক্ষা যে কোন পর্যায়ে তা নিতান্তই আপেক্ষিক তবে কনো পক্ষ থেকে এমনকি রাষ্ট্রীয় ভাবেও জীবন ঘনিষ্ঠ করা যায়নি জীবন বোধ সম্পর্কে। আর মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে উত্তরণের দায়িত্ব উপেক্ষিত হয়েছে নানা অছিলায় এবং সকল তরফ থেকেই আর এ দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না।
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায়ও জীবন ঘনিষ্ঠ উপাদানের ব্যাপক সংকট! যুগপোযোগি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায়নি এ পর্যন্ত!
প্রাসঙ্গিক ভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্তও সে সংকট থেকে অদ্যবধি মুক্তি লাভ করতে পারেনি।
” – ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল , বুঝেছ?”
শিক্ষক পড়ান আর শিক্ষার্থীরা বলে- “জ্বী –স্যার ।”
তিনি কি বুঝেছিলেন এবং কি বুঝালেন আর ওরা কি বুঝলো? কেউ জানেনা।
অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ । সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উদ্দেশ্য ঐতিহাসিক বাস্তবতা, অনিবার্যতা, এবং পরিনতি নিয়ে কত বই, লেখালেখি, ডোকুমেন্টারি, সিনেমা, নাটক,গান,কবিতা গত পঞ্চাশ বছর ধরে শেখানো হচ্ছে, দেখানো হচ্ছে বাঙালি জাতিকে । কতটুকু জেনেছি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্পর্কে?
মাকে জিজ্ঞেস করলাম-
: মা, আমার বয়স কতো? জন্ম দিন কবে?
: গন্ডোগোলের সুমায় তুই দেড় বছরের। ভাদ্দুর মাসের শুক্কুরবার।
বাহ্ , হিসাব সোজা। আমি গন্ডগোলের চেয়ে দেড় বছরের বড়!
তার মানে আমার জীবনের সুবর্ণজয়ন্তী হয়ে গেছে সঙ্গোপনে।
: মা, কি নিয়ে গন্ডগোল আর কার সাথে?
: তাক্কিন । “তয় পোরচিম পাকিস্তানের সাথে আমাগরে দ্যাশের।” সেদিন
মায়ের মুখে ‘তাক্কিন’ শুনে আশ্চর্য হইনি , বিচলিত হয়েছি আজ এই শহুরে মৌন মিছিলে অংশগ্রহনকারী যুবকের মুখে ‘তাক্কিন’শুনে। পলাশী থেকে ধানমন্ডির রাজনৈতিক পরিক্রমার ইতিহাসিক চালচিত্র গ্রামের একজন আটপৌরে সাধারণ মায়ের জানার কথা নয় ।
কিন্তু স্বাধীনতা উত্তোর পঞ্চাশ বছরে একটা প্রজন্ম জানেনা রাজনীতি কি? নেতা কে? যাচ্ছে কোথায়?
২০১৩ সালের ৩ মার্চ বগুড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় রাত দুইটার পর ফোনে ফোনে গুজব ছড়ানো হয় সাঈদীকে সরকার গোপনে ফাঁসি দিয়েছে আর এখন তাকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে! তখন থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং সকাল বেলা ইউএনও অফিস, থানা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আওয়ামীলীগের বিভিন্ন অফিসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এই গুজব ও হামলায় শিশুসহ ১১জন নিহত হয়।
এই হলো ধর্ম বিশ্বাসের জলজ্যান্ত নয় বরফজ্যান্ত উদাহরণ ।
ঐ গুজবে আত্মহারা হয়ে যারা আত্মাহুতি দিয়েছিল তাদের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো” সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে ? ” সেও হয়ত উত্তর দিত “তাক্কিন”!
পাবনা-সুজানগর সড়কে সাদুল্লাপুর বটতলা দেড় দশক আগে একজন
অপরিচিত বয়স্ক নারী মৃত্যুবরণ করেন। ঐ বটতলায় তাকে সমাহিত করা হয়। হঠাৎ সমাধী পাকা করা হল। কিছুদিন আগে সমাধীকে পাকা ঘরে রুপান্তরিত করা হয়েছে সাথে টাইল্স লাগানো একটা দানবাক্স।নাম দেওয়া হয়েছে ” পাগলী মায়ের মাজার” ইদানিং সেই মাজারে ঔরসে হয় , শিরনী রান্না- বিতরণ- মানত ইলাহি কান্ড!দুবলিয়ার মেলায় লটারি খেলা হয়। অনেকেই পাগলী মায়ের নামে টিকেট কেনে। শুনেছি লটারিতে টান ওঠে,পুরষ্কারও পায়!
একজন ভক্তকে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলাম- পাগলী মা হিন্দু না মুসলমান ? ভক্তের উত্তর-
: তাক্কিন!
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। মন্ত্রী সভায় অনুমোদিত হয়েছে। তো বেসরকারি দলের এক নেতা বাজেট নিয়ে চরম বিক্ষুব্ধ। উত্তেজনায় ঘেমে যাচ্ছেন সমালোচনা করতে করতে । তাকে জিজ্ঞেস করলাম – ভাই এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের পরিমাণ কত? তিনি উত্তর দিলেন-
: তাক্কিন!

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.